বাঙালি জাতির জীবনে একাত্তরের ৭ মার্চ অন্য যেকোনো একটি দিনের মতো ছিল
না। যদিও দিনটি ছিল অন্যান্য বছরের ফাল্গুনের দিনগুলোর মতোই পাতা ঝরার
সময়। শেষ ফাল্গুনের দুপুরটি ছিল না শীত না গরম। আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু
চড়া রোদ সেদিন ছিল না। সেদিন রেসকোর্স বা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
যে সমাবেশ হয়, সেই সমাবেশও অতীতের কোনো সমাবেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। শেখ
মুজিবুর রহমান অতীতে বহু জনসভায় বক্তৃতা করেছেন, কিন্তু সেদিনের সমাবেশে
তিনি যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন, সেটি ছিল তাঁর জীবনের অনন্য এক ভাষণ। তাঁর ৭
মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে দুটি প্রধান
দলিলের একটি। দ্বিতীয়টি ১০ এপ্রিলের বৈদ্যনাথতলার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’।
কোনো কোনো জাতির ইতিহাসে কোনো একটি প্রজন্ম খুবই ভাগ্যবান। শত দুঃখ-কষ্ট সয়েও তারা ভাগ্যবান এই জন্য যে তারা নিজের চোখে ইতিহাসের নির্মাণ দেখে। তাদের মধ্যে যাদের ইতিহাস সৃষ্টিতে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়, তাদের সৌভাগ্য সীমাহীন। আমরা বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রজন্ম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে আন্দোলনের ইতিহাস বই পড়ে জানবে, তা আমাদের চোখে দেখা।
ঘরোয়া আলোচনায় বা সেমিনারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনতে পছন্দ করতাম। কিন্তু কোনো জনসভায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তৃতা শুনতে আমার ভালো লাগত না। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ চার মাস আমি বেশ কয়েকটি জনসভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত উপকূল এলাকা থেকে ফিরে এসে মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে যে জনসভা করেন ২৩ নভেম্বর ১৯৭০; তা শুনতে দৈনিক পাকিস্তান গ্রুপের অনেকের সঙ্গে আমিও স্টেডিয়ামের দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ কথাটি সেদিন সেখানে প্রথম উচ্চারিত হয়। শুনে অনেকের মতোই কবি শামসুর রাহমান রোমাঞ্চিত হন। একাত্তরের ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায় বন্ধুদের সঙ্গে আমি মঞ্চের কাছেই ছিলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়। ছাত্রলীগের ৩ মার্চের জনসভায়ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। সর্বশেষ যে স্মরণীয় জনসভাটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম, সেটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি—বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দিন।
৭ মার্চ রক্তের অক্ষরে লেখা একটি দিন। তবে জাতির জীবনে ৭ মার্চও হঠাৎ আসেনি। তার আছে এক দীর্ঘ পটভূমি।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং কেন্দ্রের সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্র চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাদের দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষও উদাসীন ছিল না। বঙ্গবন্ধুও বুঝতে পারছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কুচক্রী মনোভাব। ইয়াহিয়া-ভুট্টো ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে সমস্ত জানুয়ারি মাসটিকে কাজে লাগান। ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে। তিনি ছয় দফার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চান। অতি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি সন্তুষ্ট হন না। এরপর জানুয়ারির শেষ হপ্তায় ভুট্টো আসেন তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছয় দফা বিষয়ে আলোচনার জন্য। তাঁর কাছে ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদী এজেন্ডা। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া-ভুট্টো দীর্ঘ আলোচনা করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া এক ঘোষণায় ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভুট্টো জানিয়ে দেন, তিনি ঢাকায় আসবেন না, কারণ ঢাকা এলে তাঁকে বাঙালিরা মেরে ফেলবে। ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আরও নেতা ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা জি এম সৈয়দও ছিলেন। তিনি করাচি গিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বলেন, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, ছয় দফায় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই।
মানুষের জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি কোনো দিনই ম্লান হয় না। তা চির-অম্লান। পাকিস্তান আমলের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারির কথা আমার মনে পড়ে। সে ছিল এক অন্য রকম শহীদ দিবস। হাজার হাজার মানুষ রাত ১০টার পর থেকে শহীদ মিনার ও আজিমপুর কবরস্থানে যেতে থাকেন। সেই লাখো জনতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। রাত ১২টা ১ মিনিটে তিনি শহীদদের কবরে ফাতেহা পাঠ করেন এবং কবরে ফুল দেন। সেখান থেকে তিনি খালি পায়ে হেঁটে আসেন শহীদ মিনাের। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সে রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হেঁটে শহীদ মিনারে আসার। সে রাতে তিনি শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কারও বাজারও হবে না, কারও কলোনিও হবে না। বায়ান্নতে তারা আমাদের ছেলেদের হত্যা করেছে। তঁারা শহীদ। এবারের সংগ্রামে আমরা হব গাজী।’
একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের রেসকোর্সে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও আমি উপস্থিত ছিলাম। নৌকার আকারে বিরাট মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে পরিবেশিত হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং বেশ কিছু গণসংগীত।
১ মার্চ পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের সভা চলছিল। তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, ৩ মার্চ যে অধিবেশন বসার কথা, তা প্রেসিডেন্ট মুলতবি করেছেন। আমি তখন ওই হোটেলের কয়েক গজ দূরে সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল অফিসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মতিঝিল, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (ওই দিনই এর নামকরণ হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এবং দৈনিক বাংলার দিক থেকে মুহুর্মুহু স্লোগান শুনতে পাই: ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ প্রভৃতি। বেরিয়ে দেখি রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা।
তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে অধিবেশন মুলতবির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি’। তিনি পরদিন ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়ে দেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক সমাবেশে ‘বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা’ করা হবে। ১ মার্চ থেকেই ৭ তারিখের জন্য মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। তখন থেকে রাজনীতি শুধু আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। সব দলমতের মানুষই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
তখন রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মওলানা ভাসানী রোড এখনকার মতো প্রশস্ত ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর দিকেও শতবর্ষী সেগুন ও মেঘশিরীষ ছিল কয়েকটি। উদ্যানটি ফাঁকা। সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। বেলা সাড়ে ১১টার সময় কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোড থেকে আমি গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র। কোনোরকমে আমি ঠাঁই পাই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকে এক গাছের তলায়, যে গাছের ডালেও বসেছিল কয়েকজন। জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টা খানেক দেরি হয়। প্রথাগত জনসভা নয়, একমাত্র বক্তা বঙ্গবন্ধু। জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। উচ্চারিত হয়: ‘ভায়েরা আমার...।’
সেদিন তিনি কী বলেছিলেন, দেশের মানুষের আজ তা মুখস্থ। ভাষণে একটি শব্দও নেই অপ্রাসঙ্গিক। একটি বাক্যও নেই অন্যায্য। ভাষণের শুরুতেই তিনি কয়েকবার ‘দুঃখ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। বাস্তবিক পক্ষেই সেদিন তিনি ‘দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে’ জনতার ‘সামনে হাজির’ হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের ওপর সামরিক জান্তার নির্মম অত্যাচার। বঙ্গবন্ধু তাঁর আন্দোলনের পটভূমি জনতার সামনে তুলে ধরেন। তবে তা বিশুদ্ধ বইয়ের ভাষায় নয়, জনগণের মুখের ভাষায়। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে কখন তাঁর কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জনগণকে জানান। পাকিস্তানের ‘মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে’ তাঁর দায়িত্ব বিরাট, তাই তিনি সবার সঙ্গে ‘আলোচনা’ ও ‘আলাপ’ করে ‘শাসনতন্ত্র তৈয়ার’ করার কথা বলেন।
ভাষণে তিনি যে চারটি শর্ত দেন, তার চেয়ে ন্যায়সংগত দাবি ওই পরিস্থিতিতে হতে পারত না। এক. সামরিক আইন প্রত্যাহার, দুই. সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, তিন. সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা, এবং চার. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি ছিল: ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আর একটি প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল: ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারার জননেতা, গেরিলা যুদ্ধের বিপ্লবী নেতা নন। তাঁর ক্ষমতার উৎস জনগণ, বন্দুকের নল নয়। সেদিনের ভাষণের বিষয়বস্তুর বিকল্প আর কী হতে পারত? তাঁর পক্ষে কি বলা সমীচীন হতো: ‘আমি ঘোষণা দিচ্ছি, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ অমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা তিনি বলেননি কারণ, পাকিস্তানের ভৌগোলিক ও অন্যান্য বাস্তবতায় তা তিনি দিতে পারেন না। তা দিলে বাংলাদেশ হতো নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা। আবেগের বশে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে দেশের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন পেলেও পৃথিবীর সমর্থন পেতেন না—এমনকি ভারতেরও নয়।
বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই বলেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য। তার জন্য আজ থেকে সংগ্রাম শুরু হলো। স্বাধীনতা কারও হাতে তুলে দেওয়ার জিনিস নয়, তা সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আরেকটু দীর্ঘ ছিল। রেকর্ড করার সময় মাঝে মাঝে কিছু কথা বাদ পড়ে থাকবে। সেকালে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা এখনকার মতো নিখুঁত ছিল না। কিন্তু তাতে ভাষণটির অঙ্গহানি ঘটেনি। ৭ মার্চের ভাষণ একটি দলিল, একটি ইতিহাস।
কোনো কোনো জাতির ইতিহাসে কোনো একটি প্রজন্ম খুবই ভাগ্যবান। শত দুঃখ-কষ্ট সয়েও তারা ভাগ্যবান এই জন্য যে তারা নিজের চোখে ইতিহাসের নির্মাণ দেখে। তাদের মধ্যে যাদের ইতিহাস সৃষ্টিতে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়, তাদের সৌভাগ্য সীমাহীন। আমরা বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রজন্ম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে আন্দোলনের ইতিহাস বই পড়ে জানবে, তা আমাদের চোখে দেখা।
ঘরোয়া আলোচনায় বা সেমিনারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনতে পছন্দ করতাম। কিন্তু কোনো জনসভায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তৃতা শুনতে আমার ভালো লাগত না। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ চার মাস আমি বেশ কয়েকটি জনসভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত উপকূল এলাকা থেকে ফিরে এসে মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে যে জনসভা করেন ২৩ নভেম্বর ১৯৭০; তা শুনতে দৈনিক পাকিস্তান গ্রুপের অনেকের সঙ্গে আমিও স্টেডিয়ামের দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ কথাটি সেদিন সেখানে প্রথম উচ্চারিত হয়। শুনে অনেকের মতোই কবি শামসুর রাহমান রোমাঞ্চিত হন। একাত্তরের ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায় বন্ধুদের সঙ্গে আমি মঞ্চের কাছেই ছিলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়। ছাত্রলীগের ৩ মার্চের জনসভায়ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। সর্বশেষ যে স্মরণীয় জনসভাটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম, সেটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি—বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দিন।
৭ মার্চ রক্তের অক্ষরে লেখা একটি দিন। তবে জাতির জীবনে ৭ মার্চও হঠাৎ আসেনি। তার আছে এক দীর্ঘ পটভূমি।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং কেন্দ্রের সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্র চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাদের দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষও উদাসীন ছিল না। বঙ্গবন্ধুও বুঝতে পারছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কুচক্রী মনোভাব। ইয়াহিয়া-ভুট্টো ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে সমস্ত জানুয়ারি মাসটিকে কাজে লাগান। ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে। তিনি ছয় দফার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চান। অতি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি সন্তুষ্ট হন না। এরপর জানুয়ারির শেষ হপ্তায় ভুট্টো আসেন তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছয় দফা বিষয়ে আলোচনার জন্য। তাঁর কাছে ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদী এজেন্ডা। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া-ভুট্টো দীর্ঘ আলোচনা করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া এক ঘোষণায় ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভুট্টো জানিয়ে দেন, তিনি ঢাকায় আসবেন না, কারণ ঢাকা এলে তাঁকে বাঙালিরা মেরে ফেলবে। ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আরও নেতা ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা জি এম সৈয়দও ছিলেন। তিনি করাচি গিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বলেন, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, ছয় দফায় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই।
মানুষের জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি কোনো দিনই ম্লান হয় না। তা চির-অম্লান। পাকিস্তান আমলের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারির কথা আমার মনে পড়ে। সে ছিল এক অন্য রকম শহীদ দিবস। হাজার হাজার মানুষ রাত ১০টার পর থেকে শহীদ মিনার ও আজিমপুর কবরস্থানে যেতে থাকেন। সেই লাখো জনতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। রাত ১২টা ১ মিনিটে তিনি শহীদদের কবরে ফাতেহা পাঠ করেন এবং কবরে ফুল দেন। সেখান থেকে তিনি খালি পায়ে হেঁটে আসেন শহীদ মিনাের। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সে রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হেঁটে শহীদ মিনারে আসার। সে রাতে তিনি শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কারও বাজারও হবে না, কারও কলোনিও হবে না। বায়ান্নতে তারা আমাদের ছেলেদের হত্যা করেছে। তঁারা শহীদ। এবারের সংগ্রামে আমরা হব গাজী।’
একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের রেসকোর্সে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও আমি উপস্থিত ছিলাম। নৌকার আকারে বিরাট মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে পরিবেশিত হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং বেশ কিছু গণসংগীত।
১ মার্চ পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের সভা চলছিল। তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, ৩ মার্চ যে অধিবেশন বসার কথা, তা প্রেসিডেন্ট মুলতবি করেছেন। আমি তখন ওই হোটেলের কয়েক গজ দূরে সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল অফিসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মতিঝিল, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (ওই দিনই এর নামকরণ হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এবং দৈনিক বাংলার দিক থেকে মুহুর্মুহু স্লোগান শুনতে পাই: ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ প্রভৃতি। বেরিয়ে দেখি রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা।
তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে অধিবেশন মুলতবির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি’। তিনি পরদিন ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়ে দেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক সমাবেশে ‘বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা’ করা হবে। ১ মার্চ থেকেই ৭ তারিখের জন্য মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। তখন থেকে রাজনীতি শুধু আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। সব দলমতের মানুষই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
তখন রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মওলানা ভাসানী রোড এখনকার মতো প্রশস্ত ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর দিকেও শতবর্ষী সেগুন ও মেঘশিরীষ ছিল কয়েকটি। উদ্যানটি ফাঁকা। সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। বেলা সাড়ে ১১টার সময় কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোড থেকে আমি গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র। কোনোরকমে আমি ঠাঁই পাই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকে এক গাছের তলায়, যে গাছের ডালেও বসেছিল কয়েকজন। জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টা খানেক দেরি হয়। প্রথাগত জনসভা নয়, একমাত্র বক্তা বঙ্গবন্ধু। জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। উচ্চারিত হয়: ‘ভায়েরা আমার...।’
সেদিন তিনি কী বলেছিলেন, দেশের মানুষের আজ তা মুখস্থ। ভাষণে একটি শব্দও নেই অপ্রাসঙ্গিক। একটি বাক্যও নেই অন্যায্য। ভাষণের শুরুতেই তিনি কয়েকবার ‘দুঃখ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। বাস্তবিক পক্ষেই সেদিন তিনি ‘দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে’ জনতার ‘সামনে হাজির’ হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের ওপর সামরিক জান্তার নির্মম অত্যাচার। বঙ্গবন্ধু তাঁর আন্দোলনের পটভূমি জনতার সামনে তুলে ধরেন। তবে তা বিশুদ্ধ বইয়ের ভাষায় নয়, জনগণের মুখের ভাষায়। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে কখন তাঁর কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জনগণকে জানান। পাকিস্তানের ‘মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে’ তাঁর দায়িত্ব বিরাট, তাই তিনি সবার সঙ্গে ‘আলোচনা’ ও ‘আলাপ’ করে ‘শাসনতন্ত্র তৈয়ার’ করার কথা বলেন।
ভাষণে তিনি যে চারটি শর্ত দেন, তার চেয়ে ন্যায়সংগত দাবি ওই পরিস্থিতিতে হতে পারত না। এক. সামরিক আইন প্রত্যাহার, দুই. সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, তিন. সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা, এবং চার. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি ছিল: ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আর একটি প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল: ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারার জননেতা, গেরিলা যুদ্ধের বিপ্লবী নেতা নন। তাঁর ক্ষমতার উৎস জনগণ, বন্দুকের নল নয়। সেদিনের ভাষণের বিষয়বস্তুর বিকল্প আর কী হতে পারত? তাঁর পক্ষে কি বলা সমীচীন হতো: ‘আমি ঘোষণা দিচ্ছি, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ অমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা তিনি বলেননি কারণ, পাকিস্তানের ভৌগোলিক ও অন্যান্য বাস্তবতায় তা তিনি দিতে পারেন না। তা দিলে বাংলাদেশ হতো নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা। আবেগের বশে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে দেশের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন পেলেও পৃথিবীর সমর্থন পেতেন না—এমনকি ভারতেরও নয়।
বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই বলেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য। তার জন্য আজ থেকে সংগ্রাম শুরু হলো। স্বাধীনতা কারও হাতে তুলে দেওয়ার জিনিস নয়, তা সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আরেকটু দীর্ঘ ছিল। রেকর্ড করার সময় মাঝে মাঝে কিছু কথা বাদ পড়ে থাকবে। সেকালে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা এখনকার মতো নিখুঁত ছিল না। কিন্তু তাতে ভাষণটির অঙ্গহানি ঘটেনি। ৭ মার্চের ভাষণ একটি দলিল, একটি ইতিহাস।
No comments:
Post a Comment