Wednesday, November 13, 2019

রাতারগুল জলাবন

 রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট (ইংরেজি: Ratargul Swamp Forest) বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবনবা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি। এই বনকে বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগের অধীনে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
চিরসবুজ এই বন গুয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত এবং চেঙ্গির খালের সাথে একে সংযুক্ত করেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম- Millettia pinnata)। বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে। বর্ষাকালে এই বনে অথৈ জল থাকে চার মাস। তারপর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ। আর তখন পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণীকুল।

ওয়াচ টাওয়ার থেকে জলাবনের দৃশ্য।
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে, গুয়াইন নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে আবার রয়েছে দুটি হাওর: শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর। সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার।

নামকরণ
সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটি গাছ "রাতা গাছ" নামে পরিচিত। সেই রাতা গাছের নামানুসারে এ বনের নাম রাতারগুল।

জলবায়ু
সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্রান্তীয় জলবায়ুর এই বনটিতে প্রতিবছর ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে । বনের সবচাইতে কাছে অবস্থিত সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্যমতে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪১৬২ মিলিমিটার । জুলাই মাসটি সবচাইতে আর্দ্র যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিহীন সবচাইতে শুষ্ক মাসটি হল ডিসেম্বর । মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ৩২° সেলসিয়াসে, আবার জানুয়ারিতে এই তাপমাত্রা নেমে আসে ১২° সেলসিয়াসে । ডিসেম্বর মাসে এখানকার আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ, যা জুলাই-আগষ্টে ৯০ শতাংশেরও বেশি ।

উদ্ভিদবৈচিত্র্
বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এই মিঠাপানির জলাবনটিতে উদ্ভিদের দু'টো স্তর পরিলক্ষিত হয়। উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান । বনের উদ্ভিদের চাঁদোয়া সর্বোচ্চ ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত । এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত । বনের স্বাস্থ্য সন্তোষজনক । এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে ।
এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণগাছ; আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম। আছে বট গাছও।

প্রাণিবৈচিত্র
জলমগ্ন বলে এই বনে সাঁপের আবাস বেশি, আছে জোঁকও; শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ; পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁসসহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি, আসে বিশালাকায় শকুনও। মাছের মধ্যে আছে টেংরা, খলিশা, রিটা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউশ, রুইসহ বিভিন্ন জাত।

পর্যটন আকর্ষণ
জলে নিম্নাংঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটকগণ। বনের ভিতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় নৌকার, তবে সেগুলো হতে হয় ডিঙি নৌকা— ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা। তবে বনে ভ্রমণ করতে অনুমতি নিতে হয় রাতারগুল বন বিট অফিস থেকে।

কীভাবে যাবেন?
বাসে যেতে পারেন, আবার ট্রেনেও। ইচ্ছে করলে বিমানেও যেতে পারেন সিলেট। বাসে গেলে ঢাকা থেকে গ্রীনলাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহনের এসি বাস যায় সিলেটে। ভাড়া ৮শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা। ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ প্রভৃতি জায়গা থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া, মামুন পরিবহন, সিলকম পরিবহন ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার নন-এসি বাসও সিলেটে যায়। এরা ভাড়া নেবে ৩শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা। ট্রেনে যেতে পারেন ঢাকা থেকে যায় উপবন এক্সপ্রেস, কালনি এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কিংবা পারাবত এক্সপ্রেসে করে। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়নন্তিকা এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ০৪ টায় ছেড়ে যায় কালনী এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শ্রেণিভেদে ভাড়া ১৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।
সিলেট শহরের পাশেই খাদিম চা বাগান আর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে রাতারগুল যাওয়ার সবচেয়ে সহজ আর সুন্দর পথ। খুব অল্প সময়েই এই পথ ধরে রাতারগুল পৌঁছানো সম্ভব।
সিএনজি অটোরিকশা বা জিপ নিয়ে আসতে হবে শ্রীঙ্গি ব্রিজ। সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই বন ঘুরেফিরে আসা যায়। সারাদিনের জন্য একটি সিএনজি বা অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১২শ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা। এছাড়া সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে লোকাল সিএনজিতে গেলে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১শ’ টাকা। শ্রীঙ্গি ব্রিজ থেকে রাতারগুলে ঢুকতে হবে জেলেদের ছোট নৌকায়। ছোট নৌকার ভাড়া পড়বে ৪শ’ থেকে ৮শ’ টাকা।
আর ইচ্ছে করলে অন্য পথেও যেতে পারেন রাতারগুল। পথটি হচ্ছে সিলেট-জাফলংয়ের গাড়িতে চড়ে নামতে হবে সারিঘাট। ভাড়া ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি চালিত বেবিটেক্সিতে চড়ে গোয়াইনঘাট বাজার। এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে রাতারগুল। সারি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে এ পথটি অনুসরণ করতে পারেন। তবে খরচ আর সময়, দুটোই বেশি লাগবে এ পথে।

কোথায় থাকবেন?
খুব ভালো হয় বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনের বাসায় থাকা গেলে। নিরাপদ বেশ। তবে তাদের বিরক্ত করতে না চাইলে কিংবা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন না থাকলে সিলেট শহরে রাতে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। শাহজালাল উপশহরে পাঁচ তারকা মানের হোটেল রোজ ভিউ। নাইওরপুল এলাকায় হোটেল ফরচুন গার্ডেন। জেল সড়কে হোটেল ডালাস। ভিআইপি সড়কে হোটেল হিলটাউন। লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন। শহরের বাইরে বিমানবন্দর সড়কে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পর্যটন মোটেল, খাদিম নগরে জেসটেট হলিডে রিসোর্ট, শুকতারা প্রকৃতি নিবাস, নাজিমগড় রিসোর্ট ইত্যাদি। এসব হোটেল রিসোর্টে ৮শ’ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।

সাবধানতা:
রাতারগুলের সৌন্দর্য দেখার ভালো সময় বর্ষাকাল। বর্ষায় বন ডুবে গেলে বেশির ভাগ সাপ ও বিষাক্তপ্রাণী আশ্রয় নেয় গাছের ডালে। আর জলে আছে জোঁক। তাই সাবধানে চলতে হবে। সাঁতার না জানা থাকলে লাইফ জ্যাকেট নিতেও ভুলবেন না। বৃষ্টিতে ভিজতে না চাইলে সাথে রাখুন ছাতা, রেইনকোট ও পানিরোধক ব্যাগ।


সংকলনঃ জনাব মোঃ নাজিমুল হাসান খান
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
তরুণ উন্নয়ন সংঘ, বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment

আন্তর্জাতিক সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস

আন্তর্জাতিক সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে   একটি জাতীয় দিবস। ১৯৬৪ সাল থেকে প্রতি বছরের ১৫ ই অক্টোবর দিবসটি...