মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩০ থেকে ৪০টি খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৫৯ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন, শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে ৫২ জন, ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ২০ জন মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন।
১লা এপ্রিল , ১৯৭১। ভারত সীমানার কাছাকাছি ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কুম্ভিপাতার ক্যাম্পে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ শিবির। এ শিবিরে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন শেরপুরের ১২ জন নির্ভীক যুবক । এরা হলেন মুমিনুল হক, মোঃ হযরত আলী হজু, আব্দুল ওয়াদুদ অদু, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মোকসেদুর রহমান হিমু, কর্ণেল আরিফ, মাসুদ মিয়া, এমদাদুল হক নীলু, হাবিবুর রহমান ফনু, আশরাফ আলী আসাদ, শাহ তালাপতুপ হোসেন মঞ্জু, ইয়াকুব ।
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী শেরপুর শহরে প্রবেশ করে। বিভিন্নস্থানে গড়ে তুলে ঘাঁটি। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ঘাঁটিতে চালায় অত্যাচার। অন্যদিকে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আঘাত হানতে থাকে শত্রু শিবিরে। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শত্রু বাহিনীর মনোবল ভাঙ্গতে থাকে এবং পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে থাকে। ১১ নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের বেশ কয়েকবার কামালপুর দুর্গে আক্রমণ চালান। ১১ দিন অবরোধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর এই ঘাঁটির পতন হয়। মোট ২২০ জন পাকিস্তানি সেনা এবং বিপুল সংখ্যক রেঞ্জার, মিলিশিয়া ও রাজাকার সদস্য বিপুল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।
১ ডিসেম্বর নালিতাবাড়ীকে শত্রুমুক্ত করতে প্রথম আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সফল হতে পারেনি তারা। ওইদিন দুই যোদ্ধা শহীদ হন। রাজাকাররা দুই যোদ্ধার মরদেহ নিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। তাদের পায়ে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে শহরের অদূরে মাটি চাপা দেয়।
৪ ডিসেম্বর কামালপুরের ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণ ও গুলি বর্ষণের মুখে স্থানীয় পাকসেনারা পিছু হটে। ৫ ডিসেম্বর থেকে পাকসেনারা তল্পিতল্পা বেঁধে কামালপুর-বক্সিগঞ্জ থেকে শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলা হয়ে শেরপুর শহর হয়ে জামালপুর অভিমুখে রওনা হয়। অবশেষে পাকসেনারা ৬ ডিসেম্বর রাতের আধারে শেরপুর শহরের উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় শেরপুর। গৌরবগাঁথা সে দিনটির কথা শেরপুরবাসীর স্মৃতিতে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
এদিন মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রয়াত জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টারযোগে নেমে শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে এক সংবর্ধনা সভায় শেরপুরকে মুক্ত বলে ঘোষণা দেন।
এসময় মুক্ত শেরপুরে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এসময় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে উপস্থিত জনতা চারদিক মুখরিত করে তোলে। এখানে দাঁড়িয়েই জগজিৎ সিং অরোরা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, মস্কো, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ দেশপ্রেম, অসীম সাহসিকতা ও মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে শেরপুর জেলার একজন মরণোত্তর বীর বীরবিক্রম (শহীদ শাহ মু'তাসীম বিল্লাহ খুররম বীর বিক্রম), দুইজন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন (কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি বীর প্রতীক ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বীর প্রতীক)। এ তিন বীর সন্তানই শ্রীবরদী উপজেলার বাসিন্দা।
শহীদ বীর বিক্রম শাহ মোতাসিম বিল্লাহ খুররম ১৯৫১ সালের ২০ নভেম্বর তৎকালীন জামালপুর মহকুমার শ্রীবরদি থানার কাকিলাকুড়া ইউনিয়নের মলামারী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত প্রগতিশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শাহ মো. মোশাররফ হোসেন এবং মা বেগম ফজিলাতুন নেছা। খুররম ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোরে জামালপুর শহরকে পাকহানাদার মুক্ত করার শেষ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে শহরের বেলটিয়ায় সন্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করে সহযোদ্ধারা পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়। খুররম ছিলেন তার দলের উপদলনেতা।
শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন:
আহমদ নগর :
মুক্তিযুদ্ধকালীন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে হানাদার বাহিনী। এটি ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়কে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। একাত্তুরে ৯ মাসই এখানে চলে তাদের নৃশংসতা। পাকিস্তানি পশুরা নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের বগাডুবি ব্রিজে নিয়ে অথবা কোয়ারি রোড, জুলগাঁওয়ে হত্যার পর এসব লাশ মাটিচাপা দিত অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। স্বাধীনতার পর আহমদ নগর স্কুল ও তার আশপাশ এলাকায় অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়।
জগৎপুর :
ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ১৯৭১ সনের ৩০ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। এদিন এই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু পরিবারের সদস্যসহ মোট ৫৮ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয় বাড়িঘর।
নাকুগাঁও :
১৯৭১ সালের ২৫ মে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তের ভোগাই নদী পার হয়ে পাকহানাদার বাহিনী ভারতের বারাঙ্গাপাড়া থানার ডালুতে গণহত্যা চালায়। এ সময় বাংলাদেশ থেকে ডালুতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিকামী মানুষ ও ভারতীয় নাগরিকসহ দুই শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়। পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে ৯ জন বিএসএফ সদস্য।
ভারতের কাটাতার ঘেঁষা এই নাকুগাঁওয়ে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ দাফন করা হয়। এছাড়াও ৯ মাসে এ স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়।
তন্তর :
নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া-মন্ডালিয়াপাড়া ইউনিয়নের তন্তর গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকহানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকারদের নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। এসময় তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সহ মোট ৭ জন শহীদ হন।
কাঁটাখালি ব্রিজ এবং রাঙ্গামাটি খাটুয়ামাড়ি গ্রাম :
শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজ। এ ব্রিজটিই ছিল তখন সীমান্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাই পাকহানাদারদের সীমান্ত এলাকায় অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে এ ব্রিজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু পর পর দু’বার অপারেশন করেও সফল না হওয়ার পর এ ব্রিজ অপারেশনে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান। ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই রাতে তিনি তার ৫৩ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাঁটাখালি ব্রিজ এবং তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে ঝিনাইগাতীর রাঙামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে আশ্রয় নেন।
পরদিন ৬ জুলাই এ গ্রামের দালাল জালাল মিস্ত্রির সহযোগিতায় পাকসেনারা তিনদিক পানিবেষ্টিত গ্রামটিতে হামলা চালায়। এ সময় সন্মুখ যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, তার চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন, ভাইপো আলী হোসেন শহীদ হন। আহত হন বেশ ক’জন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে ৯ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ৬ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
সোহাগপুর বিধবা পল্লী:
নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা তাণ্ডব চালিয়ে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষকে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর গ্রামটি প্রথমে বিধবাপাড়া ও পরে ১ বিধবাপল্লী’ হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। এ গ্রামে এখনো রয়েছে ৫৯টি গণকবর।
সূর্যদি গ্রাম :
চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন আগে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ঘটে এক নারকীয় গণহত্যা। ১৯৭১ সনের ২৪ নভেম্বর এই গ্রামে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের নারকীয়তার শিকার হন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী।
রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প :
নালিতাবাড়ী উপজেলার এই ফরেস্ট ক্যাম্পটি ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। যুদ্ধের ৯ মাস এখানে বহু মানুষকে নির্য়াতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। স্বাধীনতার পর এখানকার কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য কঙ্কাল।
এছাড়াও জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী, নকলার নারায়ণখোলা, শ্রীবরদীর কাকিলাকুড়া গ্রামে বীরবিক্রম শাহ মুতাসীন বিল্লাহ খুররমের সমাধিস্থল। শেরপুর শহরের শেরিব্রিজ, সুরেন্দ্র সাহার বাড়ির আলবদরদের টর্চার সেল, সদর থানার সামনে অ্যাডভোকেট এম এ সামাদ সাহেবের বাড়ির বধ্যভূমি, জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়সহ নানা জায়গা মহান মুক্তিযুদ্ধের নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী এসব স্থান সংরক্ষণ ও পরিচর্যার উদ্যোগই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি প্রকৃত সম্মান ও ভালবাসা।
বধ্যভূমি ও গণকবর : ১৩ টি (আহমদনগর-ঝিনাইগাতী, কোয়ারী রোড-ঝিনাইগাতী, বগাডুবি ব্রিজ-ঝিনাইগাতী, রাঙামাটিয়া-ঝিনাইগাতী, নাকুগাঁও-নালিতাবাড়ী, সোহাগপুর বিধবাপল্লী-নালিতাবাড়ী, রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট বিট অফিস-নালিতাবাড়ী, কর্ণঝোড়া-শ্রীবরদী, বালিজুড়ি-শ্রীবরদী, জগৎপুর-শ্রীবরদী, শেরী ব্রিজ-শেরপুর সদর ও থানার সম্মুখে সামাদ সাহেবের বাড়ি-শেরপুর সদর)।
(অনলাইন কালেকশন)
No comments:
Post a Comment