Saturday, March 15, 2025

যাকাতের পরিচয়, নিসাব সীমা নির্ধারণ, যাকাত বণ্টনের খাত ও পদ্ধতি ।

আমাদের দেশে স্বর্ণ, রৌপ্য, সম্পদ ও নগদ অর্থের যাকাত দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও অন্যান্য যাকাতযোগ্য মালের অর্থ যথাযথভাবে দান করা হয় না । সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও ইসলামী হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে আজকের এই আলোচনা।




যাকাতের পরিচয়

আভিধানিক অর্থ : الطهارة والنماء والبركة والمدح অর্থাৎ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। উল্লিখিত সব কয়টি অর্থই কুরআন ও হাদীছে উদ্ধৃত হয়েছে।

পারিভাষিক অর্থ : ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত নিছাব পরিমাণ মালের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার নাম যাকাত।[1]

কুরআন ও হাদীছের অনেক স্থানে ‘যাকাত’-কে ‘ছাদাক্বাহ্’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের ৮ টি মাক্কী ও ২২টি মাদানী সূরার ৩০টি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি আয়াতে ‘ছালাত’-এর সাথেই ‘যাকাত’ শব্দ এসেছে।
[1]. ফিক্বহুল মুয়াস্সার ১২১ পৃঃ।
 
নিসাব সীমা নির্ধারণ
  
ইমান, নামাজ, রোজা, হজ যেমন শিখে আমল করতে হয়, তেমনি জাকাতও জেনে বুঝে, হিসাব করে আদায় করতে হয়। হিসাব-নিকাশ ছাড়া অনুমানের ওপর ভিত্তি করে জাকাত প্রদান করলে তা পরিপূর্ণরূপে আদায় হবে না। হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমার হিসাব নেওয়ার আগে নিজের হিসাব নিজে করে রাখো।’ (বুখারি ও মুসলিম)। কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তাআলা বলবেন: ‘তোমার হিসাব-কিতাব পাঠ করো; আজ তোমার হিসাবের জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (আল কোরআন, সুরা-১৭ [৫০] আল ইসরা-বনি ইসরাইল (মাক্কি), রুকু: ২/২, আয়াত: ১৪, মঞ্জিল: ৪, পারা: ১৫ সুবহানাল্লাজি, পৃষ্ঠা ২৮৪/২)।

সোনা ৭.৫ ভরি বা তদূর্ধ্ব, রুপা ৫২.৫ ভরি বা তদূর্ধ্ব অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা, (বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা, ট্রাভেলার্স চেক, ব্যাংক চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার, মানি অর্ডার, শেয়ার সার্টিফিকেট, কোম্পানির শেয়ার, ডিও লেটার, সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি মানি, জামানত, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি। ব্যাংকে বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত; যেমন বিমা, এফডিআর, ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্টাল সেভিংস, বিশেষ সঞ্চয়, পেনশন স্কিম ও স্বেচ্ছা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডিভিডেন্ড এবং ফেরত পাওয়ার যোগ্য প্রদত্ত ঋণ, যেসব ইচ্ছা করলে তুলে আনা যায়) এবং ব্যবসাপণ্য ও শোপিস বা মূলবান পাথর (হীরা-জহরত, মণি-মাণিক্য, মুক্তা ইত্যাদি)। এসবের বর্তমান বাজারমূল্য, অর্থাৎ বর্তমানে নতুন কিনতে যে মূল্য। শেয়ার সার্টিফিকেটের নামিক মূল্য (Face Velue) ও বাজারদরের (Market Velue) মধ্যে যেটি বেশি, সেটি হিসাব করতে হবে। ব্যবসায়িক নার্সারি, হর্টিকালচার, বীজ উৎপাদন খামার, কৃষিখামার, বনজ বৃক্ষ খামার, ফলদ বৃক্ষ খামার, ঔষধি গাছের খামার, চা-বাগান, রাবারবাগান, তুলাবাগান, রেশমবাগান, আগরগাছের বাগান, অর্কিড নার্সারি ও ফুলবাগান, মুরগির খামার, মাছের খামার ইত্যাদি এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী। এসবের বর্তমান বাজারমূল্য, অর্থাৎ বর্তমানে ক্রয়মূল্য ধরতে হবে।

বাড়ি, গাড়ি, জায়গাজমি ও স্থাবর সম্পদ, যা বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি—যেগুলো বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান বিক্রয়মূল্য (বাজারদর) জাকাতের হিসাবে আসবে।

যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জাকাত প্রদানের নিয়ম হলো, কোম্পানি বা মালিকদের সম্পদ আলাদা আলাদা হিসাব করে দেওয়া হবে এবং এ সম্পদে যদি মালিক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন বা তার অন্য সম্পদসহ যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে জাকাত দিতে হবে, অন্যথায় নয়। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা ১৫)। যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত সম্পদ থেকে জাকাত প্রদান করলে সে সম্পদের জাকাত পুনরায় দিতে হবে না।

জাকাত প্রতিবছর একবারই প্রদান করতে হয়। সাহাবায়ে কিরাম সাধারণত রমজান মাসেই জাকাত আদায় করতেন। তাই রমজান মাসে আদায় করা উত্তম। রমজানের যেকোনো একটি দিনকে সমাপনী দিন ধরে উপরিউক্ত জাকাতযোগ্য খাতসমূহের সব সম্পদের হিসাব করে জাকাত নির্ধারণ করতে হবে। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অন্তত নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক চান্দ্র বছর (৩৫৪ দিন) থাকতে হবে, একে আরবিতে হাওলানে হাওল, অর্থাৎ বছর পূর্ণ হওয়া বা বছর অতিক্রান্ত হওয়া বলে। সম্পূর্ণ সম্পদের বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। জাকাত বর্ষপূর্তি বা জাকাত হিসাব সমাপনী দিনে উক্ত তিন খাতে যত সম্পদ থাকবে, পুরোটারই জাকাত দিতে হবে।

প্রতিবছর একই তারিখে ও একই সময় হিসাব করতে হবে। যেমন ১ রমজান সন্ধ্যা ৬টা। এই সময়ের এক সেকেন্ড আগে যে সম্পদ আসবে, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সময়ের এক সেকেন্ড পর যে সম্পদ আসবে, তা পরবর্তী বছরের হিসাবে যাবে।

যাকাতযোগ্য সম্পদের ‘রুবউ উশর’, অর্থাৎ ২.৫% (শতকরা আড়াই ভাগ, ৪০ ভাগের ১ ভাগ) যাকাত প্রদান করতে হবে। যাকাত চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী আদায় করতে হয়। চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১১ বা ১২ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসাবে যাকাত আদায় করতে চাইলে শতকরা ২.৫%-এর (আড়াই ভাগ) পরিবর্তে (২.৫% ভাগ ৩৫৪ x ৩৬৫) ২.৫৭৮% (বা ২.৫৮% প্রায়) দিতে হবে। অথবা মূল যাকাতের সঙ্গে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে, যথা ২.৫% ভাগ ৩৫৪ x ১১)।

যাকাতের পরিমাণ হলো প্রতি ৪০ টাকায় ১ টাকা বা ৪০ ভাগের ১ ভাগ। ১০০ টাকায় আড়াই টাকা বা শতকরা আড়াই শতাংশ। এক হাজার টাকায় পঁচিশ টাকা। এক লাখ টাকায় আড়াই হাজার টাকা। এক কোটি টাকায় আড়াই লাখ টাকা। এক শ কোটি টাকায় আড়াই কোটি টাকা। এক হাজার কোটি টাকায় পঁচিশ কোটি টাকা। এক মিলিয়নে পঁচিশ হাজার, এক বিলিয়নে পঁচিশ কোটি; এক ট্রিলিয়নে আড়াই হাজার বা পঁচিশ শত কোটি)।

অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাঁরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। কখনো দেখা যায়, তাঁদের সম্পদ অপেক্ষা ঋণের পরিমাণ বেশি। এমতাবস্থায় তাঁদের জাকাত দিতে হবে কি না? হ্যাঁ, তাঁদের ওই তিন খাতের সমুদয় সম্পদেরই জাকাত প্রদান করতে হবে। কারণ, এ ধরনের ঋণ বাদ দিলে তাঁরা বরং জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত বলে গণ্য হবেন, যা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়।

যাকাত বণ্টনের খাত ৮ টি

মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِيْ الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ-

‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্ল­াহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। নিম্নে প্রত্যেকটি খাত আলাদাভাবে আলোচনা করা হল-

(১) ফকীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ ‘ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।[1] অতএব ফকীর যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنْ تُبْدُوْا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوْهَا وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ-

‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে ছাদাক্বাহ প্রদান কর তবে উহা ভাল; আর যদি তা গোপনে কর এবং দরিদ্রদেরকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর তাদের দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে’।[2]

(২) মিসকীন : যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে দ্বিতীয় খাত হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা মিসকীনকে উল্লেখ করেছেন। আর মিসকীন হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَيْسَ الْمِسْكِيْنُ الَّذِى يَطُوْفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَلَكِنِ الْمِسْكِيْنُ الَّذِى لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيْهِ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ، وَلاَ يَقُوْمُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ-

আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয় যে এক মুঠো-দু’মুঠো খাবারের জন্য বা দুই একটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেওয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না যাতে লোকে তাকে ছাদাক্বাহ্ করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না।[3]

(৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী : আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের তৃতীয় খাত হিসাবে ঐ ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি যাকাত আদায়, হেফাযত ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত। অতএব উক্ত ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও সে চাইলে যাকাতের অংশ গ্রহণ করতে পারবে।[4]

হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ السَّاعِدِىِّ الْمَالِكِىِّ أَنَّهُ قَالَ اسْتَعْمَلَنِيْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رضى الله عنه عَلَى الصَّدَقَةِ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنْهَا وَأَدَّيْتُهَا إِلَيْهِ أَمَرَ لِيْ بِعُمَالَةٍ فَقُلْتُ إِنَّمَا عَمِلْتُ لِلَّهِ وَأَجْرِى عَلَى اللهِ، فَقَالَ خُذْ مَا أُعْطِيْتَ فَإِنِّيْ عَمِلْتُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَعَمَّلَنِيْ فَقُلْتُ مِثْلَ قَوْلِكَ فَقَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أُعْطِيْتَ شَيْئًا مِنْ غَيْرِ أَنْ تَسْأَلَ فَكُلْ وَتَصَدَّقْ-

ইবনু সায়ে‘দী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম তখন তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি ইহা করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেওয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা ছাদাক্বাহ্ কর।[5]

অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ إِلاَّ لِخَمْسَةٍ لِغَازٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَوْ لِعَامِلٍ عَلَيْهَا أَوْ لِغَارِمٍ أَوْ لِرَجُلٍ اشْتَرَاهَا بِمَالِهِ أَوْ لِرَجُلٍ كَانَ لَهُ جَارٌ مِسْكِيْنٌ فَتُصُدِّقَ عَلَى الْمِسْكِيْنِ فَأَهْدَاهَا الْمِسْكِيْنُ لِلْغَنِىِّ

আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[6]

(৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিমকে যাকাত প্রদান করা : ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।[7]

হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ بَعَثَ عَلِىٌّ رضى الله عنه وَهُوَ بِالْيَمَنِ بِذَهَبَةٍ فِيْ تُرْبَتِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَسَمَهَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ الأَقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ الْحَنْظَلِىُّ وَعُيَيْنَةُ بْنُ بَدْرٍ الْفَزَارِىُّ وَعَلْقَمَةُ بْنُ عُلاَثَةَ الْعَامِرِىُّ ثُمَّ أَحَدُ بَنِيْ كِلاَبٍ وَزَيْدُ الْخَيْرِ الطَّائِىُّ ثُمَّ أَحَدُ بَنِيْ نَبْهَانَ قَالَ فَغَضِبَتْ قُرَيْشٌ فَقَالُوْا أَتُعْطِى صَنَادِيْدَ نَجْدٍ وَتَدَعُنَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنِّيْ إِنَّمَا فَعَلْتُ ذَلِكَ لأَتَأَلَّفَهُمْ فَجَاءَ رَجُلٌ كَثُّ اللِّحْيَةِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ نَاتِئُ الْجَبِيْنِ مَحْلُوْقُ الرَّأْسِ فَقَالَ اتَّقِ اللهَ يَا مُحَمَّدُ قَالَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَمَنْ يُطِعِ اللهَ إِنْ عَصَيْتُهُ أَيَأْمَنُنِيْ عَلَى أَهْلِ الأَرْضِ وَلاَ تَأْمَنُوْنِيْ قَالَ ثُمَّ أَدْبَرَ الرَّجُلُ فَاسْتَأْذَنَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ فِيْ قَتْلِهِ يُرَوْنَ أَنَّهُ خَالِدُ بْنُ الْوَلِيْدِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَقْتُلُوْنَ أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَيَدَعُوْنَ أَهْلَ الأَوْثَانِ يَمْرُقُوْنَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ-

আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নবী (ছাঃ)-এর নিকট কিছু স্বর্ণের টুকরো পাঠালেন। তিনি তা চার ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দিলেন। (১) আল-আকরা ইবনু হানযালী যিনি মাজায়েশী গোত্রের লোক ছিলেন। (২) উআইনা ইবনু বাদার ফাযারী। (৩) যায়েদ ত্বায়ী, যিনি পরে বনী নাবহান গোত্রের ছিলেন। (৪) আলকামাহ ইবনু উলাছাহ আমেরী, যিনি বনী কিলাব গোত্রের ছিলেন। এতে কুরাইশ ও আনসারগণ অসন্তুষ্ট হলেন এবং বলতে লাগলেন, নবী (ছাঃ) নজদবাসী নেতৃবৃন্দকে দিচ্ছেন আর আমাদেরকে দিচ্ছেন না। তখন নবী (ছাঃ) বললেন, আমি তো তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এমন মনরঞ্জন করছি। তখন এক ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসল, যার চোখ দু’টি কোটরাগত, গন্ডদ্বয় ঝুলে পড়া, কপাল উঁচু, ঘন দাড়ি এবং মাথা মোড়ানো ছিল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফরমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন, আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। (আবু সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী (ছাঃ) তাকে নিষেধ করলেন। অতঃপর যখন অভিযোগকারী লোকটি ফিরে গেল, তখন নবী (ছাঃ) বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে আর মুর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। আমি যদি তাদেরকে পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম।[8]

(৫) দাস মুক্তির জন্য : যারা লিখিত কোন চুক্তির বিনিময়ে দাসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। অনুরূপভাবে বর্তমানে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমদের হাতে বন্দি হলে সে ব্যক্তিও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে।[9]

হাদীছে এসেছে,

عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ دُلَّنِيْ عَلَى عَمَلٍ يُقَرِّبُنِيْ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِيْ مِنَ النَّارِ قَالَ لَئِنْ كُنْتَ أَقْصَرْتَ الْخُطْبَةَ لَقَدْ أَعْرَضْتَ الْمَسْأَلَةَ أَعْتِقِ النَّسَمَةَ وَفُكَّ الرَّقَبَةَ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَوَلَيْسَا وَاحِدًا قَالَ لاَ عِتْقُ النَّسَمَةِ أَنْ تُفْرِدَ بِعِتْقِهَا وَفَكُّ الرَّقَبَةِ أَنْ تُعِيْنَ فِيْ ثَمَنِهَا وَالْمِنْحَةُ الْوَكُوْفُ وَالْفَىْءُ عَلَى ذِى الرَّحِمِ الظَّالِمِ فَإِنْ لَمْ تُطِقْ ذَلِكَ فَكُفَّ لِسَانَكَ إِلاَّ مِنْ خَيْرٍ-

বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রশ্ন তো তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে; কিন্তু তুমি অত্যন্ত ব্যাপক বিষয় জানতে চেয়েছ। তুমি একটি প্রাণী আযাদ করে দাও এবং একটি দাস মুক্ত করে দাও। লোকটি বলল, এ উভয়টি কি একই কাজ নয়? তিনি বললেন, না (উভয়টি এক নয়)। কেননা একটি প্রাণী আযাদ করার মানে হল, তুমি একাকী গোটা প্রাণীকে মুক্ত করে দিবে। আর একটি দাস মুক্ত করার অর্থ হল, তার মুক্তির জন্য কিছু মূল্য প্রাদানের মাধ্যমে সাহায্য করবে। (এদ্ভিন্ন জান্নাতে প্রবেশকারী কাজের মধ্যে অন্যতম হল) প্রচুর দুধ প্রদানকারী জানোয়ার দান করা এবং এমন নিকটতম আত্নীয়ের প্রতি অনুগ্রহ করা, যে তোমার উপর অত্যাচারী। যদি তুমি এ সমস্ত কাজ করতে সক্ষম না হও, ক্ষুদার্থকে খাদ্য দান কর এবং পিপাসিতকে পানি পান করাও। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর। আর যদি তোমার দ্বারা এ কাজ করাও সম্ভব না হয়, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য কথা থেকে তোমার জিহবাকে সংযত রাখ।[10]

উল্লিখিত হাদীছে ইসলাম দাসমুক্তিকে জান্নাত লাভের বিশেষ মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করেছে। আর দাসমুক্তির জন্য যেহেতু প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস যাকাত বণ্টনের খাত সমূহের মধ্যে দাসমুক্তিকে উল্লেখ করেছেন।

(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ قَبِيصَةَ بْنِ مُخَارِقٍ الْهِلاَلِىِّ قَالَ تَحَمَّلْتُ حَمَالَةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَسْأَلُهُ فِيْهَا فَقَالَ أَقِمْ حَتَّى تَأْتِيَنَا الصَّدَقَةُ فَنَأْمُرَ لَكَ بِهَا قَالَ ثُمَّ قَالَ يَا قَبِيْصَةُ إِنَّ الْمَسْأَلَةَ لاَ تَحِلُّ إِلاَّ لأَحَدِ ثَلاَثَةٍ رَجُلٍ تَحَمَّلَ حَمَالَةً فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَهَا ثُمَّ يُمْسِكُ وَرَجُلٍ أَصَابَتْهُ جَائِحَةٌ اجْتَاحَتْ مَالَهُ فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ وَرَجُلٍ أَصَابَتْهُ فَاقَةٌ حَتَّى يَقُوْمَ ثَلاَثَةٌ مِنْ ذَوِى الْحِجَا مِنْ قَوْمِهِ لَقَدْ أَصَابَتْ فُلاَنًا فَاقَةٌ فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ فَمَا سِوَاهُنَّ مِنَ الْمَسْأَلَةِ يَا قَبِيْصَةُ سُحْتًا يَأْكُلُهَا صَاحِبُهَا سُحْتًا-

কাবীছা ইবনু মাখারেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি কিছু ঋণের যিম্মাদার হয়েছিলাম। অতএব এ ব্যাপারে কিছু চাওয়ার জন্য আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, (মদ্বীনায়) আবস্থান কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট যাকাতের মাল না আসে। তখন আমি তা হতে তোমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দান করব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, মনে রেখ হে কাবীছা! তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল নয়। (১) যে ব্যক্তি কোন ঋণের যিম্মাদার হয়েছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তা পরিশোধ করে। তারপর তা বন্ধ করে দিবে। (২) যে ব্যক্তি কোন বালা মুছীবতে আক্রান্ত হয়েছে যাতে তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না তার প্রয়োজন পূর্ণ করার মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কোন কিছু লাভ করে এবং (৩) যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হয়েছে এমনকি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন তিন জন ব্যক্তি তার দারিদ্র্যের ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করেছে তার জন্য (যাকাতের মাল থেকে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তার জীবিকা নির্বাহের মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কিছু লাভ করে। হে কাবীছা! এরা ব্যতীত যারা (যাকাতের মাল থেকে) চায় তারা হারাম খাচ্ছে।[11]

(৭) আল্লাহর রাস্তায় : আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বা আল্লাহর রাস্তার অন্তর্ভুক্ত। জিহাদ, দ্বীনী ইলম অর্জনের যাবতীয় পথ এবং দ্বীন প্রচারের যাবতীয় মাধ্যম এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে এসেছে,

আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[12]

(৮) মুসাফির : সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। এক্ষেত্রে উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।

শক্তিশালী ও কর্মক্ষম ব্যক্তির যাকাতের মাল ভক্ষণের হুকুম

শক্তিশালী ও কর্মক্ষম ব্যক্তির জন্য যাকাতের মাল ভক্ষণ করা বৈধ নয়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ وَلاَ لِذِى مِرَّةٍ سَوِىٍّ-

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত হালাল নয় এবং সুস্থ-সবল ব্যক্তির জন্যও হালাল নয়’।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَدِىِّ بْنِ الْخِيَارِ قَالَ أَخْبَرَنِيْ رَجُلاَنِ أَنَّهُمَا أَتَيَا النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فِيْ حَجَّةِ الْوَدَاعِ وَهُوَ يَقْسِمُ الصَّدَقَةَ فَسَأَلاَهُ مِنْهَا فَرَفَعَ فِيْنَا الْبَصَرَ وَخَفَضَهُ فَرَآنَا جَلْدَيْنِ فَقَالَ إِنْ شِئْتُمَا أَعْطَيْتُكُمَا وَلاَ حَظَّ فِيْهَا لِغَنِىٍّ وَلاَ لِقَوِىٍّ مُكْتَسِبٍ-

আদী ইবনুল খিয়ার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘দুই ব্যক্তি আমাকে বর্ণনা করেছেন যে, তারা বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন। তখন তিনি ছাদাকাহ্ (যাকাত) বণ্টন করছিলেন। তারা উভয়ে তাঁর নিকট (যাকাত) থেকে কিছু চাইলেন। তিনি আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং নীচু করলেন। তিনি দেখলেন, আমরা দু’জনই স্বাস্থবান। তিনি বললেন, যদি তোমরা চাও আমি তোমাদেরকে দিব। তবে তাতে বিত্তশালীর এবং কোন শক্তিশালী ও কর্মক্ষম ব্যক্তির অংশ নেই’।[2]

পিতা-মাতাকে যাকাত দেওয়ার বিধান


পিতা-মাতাকে যাকাতের মাল দেওয়া জায়েয নয়। কেননা সন্তান-সন্তুতি ও তার সম্পদ মূলত পিতা-মাতারই। এছাড়া সন্তানের উপর একান্ত কর্তব্য হল, তার সম্পদ থেকে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বহন করা। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ لِيْ مَالاً وَوَلَدًا وَإِنَّ وَالِدِيْ يَجْتَاحُ مَالِيْ قَالَ أَنْتَ وَمَالُكَ لِوَالِدِكَ إِنَّ أَوْلاَدَكُمْ مِنْ أَطْيَبِ كَسْبِكُمْ فَكُلُوْا مِنْ كَسْبِ أَوْلاَدِكُمْ-

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার সম্পদ ও সন্তান রয়েছে। আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী। তিনি বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য। তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের উত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপার্জন থেকে ভক্ষণ কর।[1]

[1]. আবুদাউদ হা/৩৫৩০; মিশকাতা হা/৩৩৫৪; আলবানী, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪১৪।


নিজের স্বামীকে যাকাত দেওয়ার বিধান

স্ত্রী যাদি নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। আর তার স্বামী যদি দরিদ্র হয় তাহলে সে তার স্বামীকে যাকাত দিতে পারে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللهِ قَالَتْ كُنْتُ فِيْ الْمَسْجِدِ فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ وَكَانَتْ زَيْنَبُ تُنْفِقُ عَلَى عَبْدِ اللهِ وَأَيْتَامٍ فِيْ حَجْرِهَا، قَالَ فَقَالَتْ لِعَبْدِ اللهِ سَلْ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَيَجْزِى عَنِّيْ أَنْ أُنْفِقَ عَلَيْكَ وَعَلَى أَيْتَامِيْ فِيْ حَجْرِى مِنَ الصَّدَقَةِ فَقَالَ سَلِيْ أَنْتِ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَانْطَلَقْتُ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَوَجَدْتُ امْرَأَةً مِنَ الأَنْصَارِ عَلَى الْبَابِ، حَاجَتُهَا مِثْلُ حَاجَتِيْ، فَمَرَّ عَلَيْنَا بِلاَلٌ فَقُلْنَا سَلِ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَيَجْزِى عَنِّيْ أَنْ أُنْفِقَ عَلَى زَوْجِيْ وَأَيْتَامٍ لِيْ فِيْ حَجْرِى وَقُلْنَا لاَ تُخْبِرْ بِنَا فَدَخَلَ فَسَأَلَهُ فَقَالَ مَنْ هُمَا قَالَ زَيْنَبُ قَالَ أَىُّ الزَّيَانِبِ قَالَ امْرَأَةُ عَبْدِ اللهِ قَالَ نَعَمْ لَهَا أَجْرَانِ أَجْرُ الْقَرَابَةِ وَأَجْرُ الصَّدَقَةِ-

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ)-এর স্ত্রী যয়নব (রাঃ) বলেন, আমি মসজিদে নববীতে ছিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখলাম, তিনি বললেন, তোমরা ছাদাক্বাহ্ কর যদিও তোমাদের অলংকার থেকে হয়। আর যয়নব (তাঁর স্বামী) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ ও তাঁর কোলের এতীমদের জন্য ব্যয় করতেন (যাকাত দিতেন)। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ)-কে বললেন, রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করুন, আমি যদি যাকাতের মাল আপনার জন্য এবং আমার কোলের এতীমদের জন্য ব্যয় করি তাহলে যথেষ্ট হবে কি? আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বললেন, বরং তুমি নিজেই জিজ্ঞেস কর। তখন আমি নবী (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। দেখলাম আরেকজন আনসারী মহিলা দরজায় অপেক্ষা করছে, সেও আমার ন্যায় প্রয়োজনবোধে এসেছে। এমতাবস্থায় আমাদের নিকট দিয়ে বেলাল (রাঃ) অতিক্রম করছিলেন। আমরা বললাম, নবী (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করুন, আমি যদি আমার স্বামী এবং আমার কোলের এতীমদের যাকাত দেই তাহলে কি আমার যাকাত আদায় হবে? আর তাঁকে (রাসূল) আমাদের বিষয়ে বল না। বেলাল (রাঃ) গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি বললেন, তারা কারা? বেলাল (রাঃ) বললেন, যয়নব। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কোন যয়নব? বেলাল (রাঃ) বললেন, তিনি হলেন, ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর স্ত্রী। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তার জন্য দু’টি বিনিময় হবে। ছাদাক্বার বিনিময় এবং আত্নীয়তা রক্ষার বিনিময়।[1]

[1]. বুখারী হা/১৪৬৬।

নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যাকাত দেওয়ার বিধান

নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যাকাতের সম্পদ দেওয়া যাবে না। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ أَمَرَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِالصَّدَقَةِ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ عِنْدِى دِيْنَارٌ فَقَالَ تَصَدَّقْ بِهِ عَلَى نَفْسِكَ قَالَ عِنْدِى آخَرُ قَالَ تَصَدَّقْ بِهِ عَلَى وَلَدِكَ قَالَ عِنْدِى آخَرُ قَالَ تَصَدَّقْ بِهِ عَلَى زَوْجَتِكَ أَوْ قَالَ زَوْجِكَ قَالَ عِنْدِى آخَرُ قَالَ تَصَدَّقْ بِهِ عَلَى خَادِمِكَ قَالَ عِنْدِى آخَرُ قَالَ أَنْتَ أَبْصَرُ

আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (ছাঃ) ছাদাক্বাহ্ করার নির্দেশ দিলেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার নিকট একটা দ্বীনার রয়েছে। তিনি বললেন, তা তোমার নিজের জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল, আমার নিকট অন্য একটি আছে। তিনি বললেন, তা তোমার সন্তানের জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল, আমার নিকট অন্য একটি আছে। তিনি বললেন, তা তোমার স্বামী অথবা স্ত্রীর জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল, আমার নিকট অন্য আরো একটি আছে। তিনি বললেন, তা তোমার খাদেমের জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল, আমার নিকট অন্য একটি আছে। তিনি বললেন, সে ব্যাপারে তুমি ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও’।[1]

উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নিজের স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর উপর এবং পিতা হিসাবে সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও তার উপর। অতএব নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

[1]. আবুদাউদ হা/১৬৯১; নাসাঈ হা/২৫৩৫; মিশকাত হা/১৯৪০; আলবানী, সনদ হাসান; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৯৫।

নিকটাত্মীয়কে যাকাত দেওয়ার বিধান

কোন নিকটাত্মীয় প্রকৃতপক্ষে যাকাতের হকদার হলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। এমনকি এতে দ্বিগুণ ছওয়াব অর্জিত হবে।

হাদীছে এসেছে,

عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِيْنِ صَدَقَةٌ وَهِىَ عَلَى ذِى الرَّحِمِ ثِنْتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ-

সালমান ইবনু আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মিসকীনকে ছাদাক্বাহ্ দিলে একটি ছাদাক্বাহ্ হয়। কিন্তু সে যদি রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় হয়, তবে নেকী দ্বিগুণ হয়। (১) ছাদাক্বার নেকী (২) আত্মীয়তা রক্ষার নেকী’।[1]

[1].মুসনাদে আহমাদ হা/১৬২৭৭; তিরমিযী হা/৬৫৮; মিশকাত হা/১৯৩৯; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অমুসলিমদেরকে যাকাত দেওয়ার বিধান

যাকাতের মাল কোন অমুসলিমকে দেওয়া শরী‘আত সম্মত নয়। কেননা শুধুমাত্র ধনী মুসলিমদের উপর যাকাত ফরয করা হয়েছে এবং গরীব মুসলিমদের মধ্যে তা বণ্টনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর তাদের দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে’।[1]

[1]. বুখারী হা/১৩৯৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘যাকাত ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ বুখারী ২/৭৫ পৃঃ; মুসলিম হা/১৯।

যাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদ ও গোরস্থান তৈরীর বিধান

যাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদ ও গোরস্থান তৈরী করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যাকাত বিতরণের খাতগুলি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যাকাত হল কেবল ফক্বীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, যাদের অন্তর (ইসলামের দিকে) আকর্ষণ করা প্রয়োজন, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান (তওবা ৯/৬০)। মসজিদ ও গোরস্থান উক্ত খাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

নিজের প্রদানকৃত যাকাতের মাল পুনরায় ক্রয় করার হুকুম

কোন ব্যক্তিকে যাকাত ও ছাদাক্বাহ্ প্রদানের পরে পুনরায় উক্ত দানকৃত মাল ক্রয় করা জায়েয নয়।

হাদীছে এসেছে,

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ قَالَ سَمِعْتُ عُمَرَ رضى الله عنه يَقُوْلُ حَمَلْتُ عَلَى فَرَسٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، فَأَضَاعَهُ الَّذِى كَانَ عِنْدَهُ، فَأَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِيَهُ، وَظَنَنْتُ أَنَّهُ يَبِيْعُهُ بِرُخْصٍ، فَسَأَلْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لاَ تَشْتَرِ وَلاَ تَعُدْ فِيْ صَدَقَتِكَ، وَإِنْ أَعْطَاكَهُ بِدِرْهَمٍ، فَإِنَّ الْعَائِدَ فِيْ صَدَقَتِهِ كَالْعَائِدِ فِيْ قَيْئِهِ-

যায়েদ ইবনু আসলাম (রাঃ) বলেন, আমি ওমর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আমার একটি ঘোড়া আল্লাহর পথে দান করলাম। যার কাছে ঘোড়াটি ছিল সে এর হক্ব আদায় করতে পারল না। তখন আমি তা ক্রয় করার ইচ্ছা করলাম। আমার ধারণা ছিল যে, সে তা কম মূল্যে বিক্রয় করবে। এ সম্পর্কে নবী (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তুমি তা ক্রয় করবে না এবং তোমার ছাদাক্বাহ্ ফিরিয়ে নিবে না যদিও সে তোমাকে তা এক দিরহামের বিনিময়ে দেয়। কেননা যে ব্যক্তি নিজের ছাদাক্বাহ্ ফিরিয়ে নেয় সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে নিজের বমি পুনরায় ভক্ষণ করে।[1]

[1]. বুখারী হা/১৪৯০, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/১২২ পৃঃ; মুসলিম হা/১৬২০; মিশকাত হা/১৯৫৪।

নিজের প্রদানকৃত যাকাতের মালের ওয়ারিছ হলে তার হুকুম

যদি কোন ব্যক্তি এমন কাউকে যাকাত প্রদান করে, যার মৃত্যুর পরে সে উক্ত সম্পদের ওয়ারিছ হয়, তাহলে তার জন্য উক্ত ওয়ারিছ সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ ভক্ষণ জায়েয।

হাদীছে এসেছে

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ كُنْتُ تَصَدَّقْتُ عَلَى أُمِّيْ بِوَلِيْدَةٍ وَإِنَّهَا مَاتَتْ وَتَرَكَتْ تِلْكَ الْوَلِيْدَةَ قَالَ قَدْ وَجَبَ أَجْرُكِ وَرَجَعَتْ إِلَيْكِ فِيْ الْمِيْرَاثِ-

বুরায়দাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, এক মহিলা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, আমি আমার মাকে একটি দাসী দান করেছিলাম। আমার মা তাকে রেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বললেন, তুমি তোমার দানের নেকী পেয়ে গেছ এবং তা উত্তরাধিকার সূত্রে তোমার নিকট ফিরে এসেছে।[1]

[1]. আবুদাউদ হা/১৬৫৬, ‘যাকাত’ অধ্যায়, আলবানী, সনদ ছহীহ।

ভুলবশত নির্ধারিত ৮ টি খাতের বাইরে প্রদান করলে যাকাত আদায় হবে কি?


ভুলবশত নির্ধারিত ৮ টি খাতের বাইরে যাকাত প্রদান করলে তা আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় তা আদায় করতে হবে না।

হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ قَالَ رَجُلٌ لأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ زَانِيَةٍ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى زَانِيَةٍ قَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ لأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ غَنِىٍّ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ عَلَى غَنِىٍّ قَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِىٍّ لأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ عَلَى سَارِقٍ فَقَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ وَعَلَى غَنِىٍّ وَعَلَى سَارِقٍ فَأُتِىَ فَقِيْلَ لَهُ أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ أَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا وَلَعَلَّ الْغَنِىَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ وَلَعَلَّ السَّارِقَ يَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ-

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি মনস্থির করে বলল, আমি আজ রাত্রে ছাদাক্বাহ্ করব। সে তার ছাদাক্বাহ্ নিয়ে বের হল এবং ব্যভিচারিণীর হাতে দিয়ে আসল। এতে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে ব্যভিচারিণী ছাদাক্বাহ্ পেয়েছে। লোকটি বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারিণীর ছাদাক্বাহ্ লাভের জন্য তোমার প্রশংসা করছি। পুনরায় আজ আমি ছাদাক্বাহ্ করব। সে তার ছাদাক্বাহ্ নিয়ে বের হল এবং একজন ধনী লোকের হতে দিয়ে আসল। এতে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে ধনী ব্যক্তি ছাদাক্বাহ্ পেয়েছে। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহ! ধনী লোকের ছাদাক্বাহ্ লাভের জন্য আমি তোমার প্রশংসা করছি। আমি আবারও ছাদাক্বাহ্ করব। সে তার ছাদাক্বাহ্ নিয়ে বের হল এবং একজন চোরকে দিয়ে আসল। এতে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে একজন চোর ছাদাক্বাহ্ পেয়েছে। লোকটি বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারিণী, ধনী ও চোরের ছাদাক্বাহ্ লাভের জন্য তোমার প্রশংসা করছি। তারপর তাকে স্বপ্নে বলা হল, তুমি যে ব্যভিচারিণীকে ছাদাক্বাহ্ দিয়েছ, সম্ভবত সে তার ব্যভিচার থেকে বিরত থাকবে। আর তুমি যে ধনী ব্যক্তিকে ছাদাক্বাহ্ করেছ, সম্ভবত সে এটা থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং আল্লাহ তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন সে তা থেকে দান করবে। আর তুমি যে চোরকে ছাদাক্বাহ্ দিয়েছ, সম্ভবত সে চুরি থেকে বিরত থাকবে।

[1]. মুসলিম হা/১০২২।

নির্ধারিত ৮ টি খাতে যাকাত বণ্টনের পদ্ধতি


আল্লাহ তা‘আলা সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যাকাত প্রদানের যে ৮টি খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার মধ্যেই যাকাত বণ্টন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর বাইরে যাকাত প্রদান করা সিদ্ধ নয়। তবে যাকাতকে সমান ৮ ভাগে ভাগ করতে হবে না। বরং ৮টি খাতের মধ্যে যে খাতগুলো পাওয়া যাবে সেগুলোর মধ্যে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে কম-বেশী করে যাকাত বণ্টন করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কোন একটি খাতে সম্পূর্ণ যাকাত প্রদান করলেও তা আদায় হয়ে যাবে।


Collected by: Md. Nazimul Hasan Khan- Founder & President- Torun Unnayan Songo, Sherpur, Bangladesh.


Monday, March 10, 2025

রোজা ও ফিদিয়া কি এবং রোজা না রাখার বিধান ও ফিদিয়া আদায়ের নিয়ম

রমযানের রোযা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোযার স্থান। রোযার আরবি শব্দ সওম, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়-প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর`নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমযান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয`নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমযান রোযা রাখা ফরয। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

(তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।-সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন-

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

(তরজমা) সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।- সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فافطروا، فإن غم عليكم فصوموا ثلاثين،

وفي رواية : صوموا لرؤيته وأفطروا لرويته، فإن عم عليكم فاكملوا العدد.

যখন তোমরা (রমযানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোযা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোযা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোযা রাখবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০৮০ (১৭-১৮)


যাদের জন্য রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে:

রমজানের রোজা রাখা প্রতিটি সুস্থমস্তিস্ক সম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য ফরজ।
কোনো বৈধ কারণ ছাড়া রোজা না রাখা বা ভেঙে ফেলা হারাম। তবে শরীয়ত কিছু বিশেষ অবস্থায় রোজা না রাখার বা ভেঙে ফেলার অনুমতি দিয়েছে।

১. মুসাফির

মাসআলা: মুসাফিরের জন্য সফরের হালতে রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে অস্বাভাবিক কষ্ট না হলে রোজা রাখাই উত্তম। আর অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোজা রাখা মাকরূহ। এ অবস্থায় রোজা না রেখে পরে তা কাজা করবে।
আছিম রহ. বলেন, আনাস রা.কে সফরকালে রোজা রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, যে রোজা রাখবে না, সে অবকাশ গ্রহণ করল আর যে রোজা রাখল সে উত্তম কাজ করল। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৩২; রদ্দুল মুহতার ২/৪২১; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪০৩

মাসআলা: সফরের হালতে রোজা রাখা শুরু করলে তা আর ভাঙা জায়েজ নয়। কেউ ভেঙে ফেললে গুনাহগার হবে। তবে কাফফারা আসবে না। শুধু কাজাই যথেষ্ট।

আনাস রা. বলেন, কেউ রোজা রেখে সফরে বের হলে রোজা ভাঙবে না। তবে যদি পিপাসার কারণে প্রাণনাশের আশঙ্কা হয় তাহলে রোজা ভাঙতে পারবে, পরে তা কাজা করে নেবে। ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪০৩; রদ্দুল মুহতার ২/৪৩১

মাসআলা: মুসাফির সফরের কারণে রোজা রাখেনি, কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই মুকীম হয়ে গেল। তাহলে দিনের অবশিষ্ট সময় রমজানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে পরবর্তী সময়ে এ রোজার কাজা অবশ্যই করতে হবে।

ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেন, যে মুসাফির রমজানের দিনে (সফরের হালতে) পানাহার করেছে সে মুকীম হয়ে গেলে দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪২৮

মাসআলা: রমজানের দিনে হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র হলে অবশিষ্ট দিন রমজানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে এই ওযরে ছুটে যাওয়া রোজাগুলোর সাথে এ দিনের রোজাও কাজা করবে।

হাসান রাহ. বলেন, সুবহে সাদিকের পর যে হায়েয থেকে পবিত্র হয়েছে সে দিনের বাকি অংশে পানাহার করবে না। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪২৮; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১

২. অসুস্থ ব্যক্তি

মাসআলা: রোজার কারণে যে রোগ বৃদ্ধি পায় বা রোগ দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে সে রোগে রোজা ভাঙার অবকাশ আছে।

উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে। আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২২

৩. গর্ভবতী

মাসআলা: রোজা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলা নিজের কিংবা সন্তানের প্রাণহানী বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর প্রবল আশঙ্কা করলে তার জন্য রোজা ভাঙা জায়েজ। পরে এ রোজা কাজা করে নেবে। —আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২২

৪. দুগ্ধদানকারিণী

মাসআলা: দুগ্ধদানকারিণী মা রোজা রাখলে যদি সন্তান দুধ না পায় আর ঐ সন্তান অন্য কোনো খাবারেও অভ্যস্ত না হয়, ফলে দুধ না পাওয়ার কারণে সন্তানের মৃত্যুর বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর আশঙ্কা হয়, তাহলে তিনি রোজা ভাঙতে পারবেন এবং পরে কাজা করে নেবেন।

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের জন্য রোজার হুকুম শিথিল করেছেন এবং আংশিক নামাজ কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণীর জন্যও রোজার হুকুম শিথিল করেছেন। জামে তিরমিযী ১/১৫২; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২২

৫. দুর্বল বৃদ্ধ ব্যক্তি

মাসআলা : বার্ধক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে সক্ষম না হলে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে একজন গরীবকে দুই বেলা খাবার খাওয়াবে অথবা পৌনে দু কেজি গমের মূল্য সদকা করবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন— আর যাদের রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদইয়া-একজন মিসকীনকে খাবার প্রদান করবে। সূরা বাকারা (০২) : ১৮৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭


অন্তঃসত্ত্বা নারীর রোজার মাসয়ালা:

গর্ভবতী নারীদের মধ্যে রোজা নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্ন থাকে। কেউ বলে রোজা রাখা যাবে, আবার কেউ বলে যাবে না। প্রকৃতপক্ষে রোজা রাখা যাবে কি না তা নির্ভর করে গর্ভবতীর স্বাস্থ্য ও গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর।

রোজা রাখার কারণে গর্ভবতী নারী নিজের বা তার সন্তানের প্রাণহানী বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর প্রবল আশঙ্কা হলে তার জন্য রোজা না রাখা বা ভাঙা জায়েয। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।

হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের জন্য রোজার হুকুম শিথিল করেছেন এবং আংশিক নামাজ কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনীর জন্যও রোজার হুকুম শিথিল করেছেন। (জামে তিরমিযী- ৭১৫)

হজরত আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে গর্ভবর্তী নারী নিজের জীবনের আশংকা করে এবং যে স্তন্যদানকারী নারী নিজের সন্তানের জীবনের উপর আশংকা করে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এদের উভয়ের জন্য সাওম ছেড়ে দেওয়ার অবকাশ দিয়েছেন। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নং: ১৬৬৮)

দুগ্ধপানকারিনী ও গর্ভবতী মায়ের দুইটি অবস্থা হতে পারে:

১. রোজা রাখার দ্বারা তার স্বাস্থ্যের উপর কোন প্রভাব না পড়বে না। অর্থাৎ তার জন্য রোজা রাখাটা কষ্টকর না হওয়া এবং তার সন্তানের জন্যেও আশংকাজনক না হওয়া। এমন নারীর উপর রোজা রাখা ফরজ; তার জন্য রোজা ভাঙা নাজায়েজ।

২. রোজা রাখলে তার নিজের স্বাস্থ্য অথবা সন্তানের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার আশংকা করা এবং তার জন্যে রোজা রাখাটা কষ্টকর হওয়া। এমন নারীর জন্য রোজা না-রাখা জায়েয আছে; তিনি এ রোজাগুলো পরবর্তীতে কাজা পালন করবেন। বরং এ অবস্থায় নারীর জন্য রোজা না-রাখাই উত্তম; রোজা রাখা মাকরূহ।

কোন কোন আলেম উল্লেখ করেছেন যদি তার সন্তানের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশংকা হয় তাহলে তার উপর রোজা ছেড়ে দেওয়া ফরজ; রোজা রাখা হারাম।

আল-মুরদাউয়ি ‘আল-ইনসাফ’ নামক গ্রন্থে (৭/৩৮২) বলেন: এমতাবস্থায় এ নারীর জন্য রোজা রাখা মাকরূহ...। ইবনে আকীল উল্লেখ করেছেন যে, গর্ভবতী ও দুগ্ধপানকারিনী নারী যদি নিজের গর্ভস্থিত ভ্রূণ ও সন্তানের ক্ষতির আশংকা করেন তাহলে রোজা রাখা জায়েজ হবে না; আর যদি ক্ষতির আশংকা না করেন তাহলে রোজা ছেড়ে দেয়া জায়েয হবে না।



রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া কখন ও কীভাবে দেবেন:

যে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির রোজা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাজা করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই, এমন ব্যক্তি রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া প্রদান করবে। (সুরা বাকারা: ১৮৪)

ছাবেত আলবুনানী (রহ.) বলেন, আনাস ইবনে মালেক (রা.) যখন বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না তখন তিনি রোজা না রেখে (ফিদিয়া) খাবার দিতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযযাক, হাদিস ৭৫৭০)

ইকরিমা (রহ.) বলেন, আমার মা প্রচণ্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তার সম্পর্কে আমি তাউসকে (রহ.) জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, প্রতিদিনের পরিবর্তে মিসকীনকে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম দান করবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭৫৮১)

মাসআলা

এক রোজার পরিবর্তে এক ফিদিয়া ফরজ হয়। এক ফিদিয়া হল, কোনো মিসকিনকে দুই বেলা পেট ভরে খাবার খাওয়ানো অথবা এর মূল্য প্রদান করা।

হজরত সায়ীদ ইবনে মুসায়্যিব (রহ.) বলেন (আর যাদের রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদিয়া একজন মিসকিনকে খাবার প্রদান করবে) এই আয়াত রোজা রাখতে অক্ষম বৃদ্ধের জন্য প্রযোজ্য। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭৫৮৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৬)

যাদের জন্য রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া দেওয়ার অনুমতি রয়েছে তারা রমজানের শুরুতেই পুরো মাসের ফিদিয়া দিয়ে দিতে পারবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৭)

উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মানুষ ছাড়া (অর্থাৎ দুর্বল বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ব্যক্তি, যার ভবিষ্যতে রোজার শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই) আরো যাদের জন্যে রোজা ভাঙা জায়েজ আছে, (যেমন, মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারিণী) তারা রোজা না রাখলে রোযার ফিদিয়া দেবে না; বরং পরে কাজা করবে।

আর ওযরের হালতে মৃত্যুবরণ করলে কাজা ও ফিদিয়া কিছুই ওয়াজিব হবে না। অবশ্য ওযরের হালত শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ মুসাফির মুকিম হওয়ার পর, গর্ভবতী নারীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া ও স্রাব বন্ধ হওয়ার পর এবং স্তন্যদানকারিণী স্তন্যদান বন্ধ করার পর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে ওযর শেষে যে কয়দিন সময় পেয়েছে সে কয়দিনের কাজা জিম্মায় আসবে। কাজা না করলে উক্ত দিনগুলোর ফিদিয়া প্রদানের ওসিয়ত করে যেতে হবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩—৪২৪; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গর্ভবতী নারী ও শিশুকে স্তন্যদানকারিণীর জন্যে রমজানে রোজা না রাখার অবকাশ রয়েছে। তারা ফিদিয়া আদায় করবে না; বরং রোজাগুলো কাযা করে নেবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭০৬৪)

ছুটে যাওয়া রোজার কাজা সম্ভব না হলে মৃত্যুর পূর্বে ফিদিয়া দেওয়ার ওসিয়ত করে যাওয়া জরুরি। ওসিয়ত না করে গেলে ওয়ারিশরা মৃতের পক্ষ থেকে ফিদিয়া দিয়ে দিলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন।

তবে মৃতব্যক্তি ওসিয়ত না করে গেলে সেক্ষেত্রে মিরাসের ইজমালী সম্পদ থেকে ফিদিয়া দেওয়া হবে না। একান্ত দিতে চাইলে বালেগ ওয়ারিশরা তাদের অংশ থেকে দিতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪২৪-৪২৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭)

এক রোজার ফিদিয়া একজন মিসকিনকে দেওয়া উত্তম। তবে একাধিক ব্যক্তিকে দিলেও ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। একাধিক ফিদিয়া এক মিসকিনকে দেওয়া জায়েজ।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যে বৃদ্ধ রোজা রাখতে সক্ষম নন তিনি রোজা না রেখে প্রতি দিনের পরিবর্তে একজন মিসকিনকে আধা সা (অর্থাৎ প্রায় পৌনে দুই কেজি) গম দিয়ে দেবেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭৫৭৪; আলবাহরুর রায়েক ২/৮৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭)

দারিদ্র্যের কারণে কেউ যদি ফিদিয়া আদায় করতে অক্ষম হন, তাহলে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। পরে কখনো সামর্থ্যবান হলে ফিদিয়া আদায় করে দেবেন।

কেউ যদি সুস্থ হয়ে ওঠা বা রোজা রাখার সক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে তার জিম্মায় ওয়াজিব থাকা কাজা রোজার ফিদিয়া আদায় করে, কিন্তু পরবর্তীতে আবার রোজা রাখার সক্ষমতা ফিরে পায়, তাহলে তার জন্য ওই রোজাগুলোর কাজা আদায় করা আবশ্যক। পূর্বের আদায়কৃত ফিদিয়া বাতিল হয়ে যাবে এবং তা নফল সদকা গণ্য হবে। 

 

হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

‏ مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ رُخْصَةٍ وَلاَ مَرَضٍ لَمْ يَقْضِ عَنْهُ صَوْمُ الدَّهْرِ كُلِّهِ وَإِنْ صَامَهُ

যে ব্যক্তি কোনো ওযর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমযানের একটি রোযা পরিত্যাগ করবে সে যদি ঐ রোযার পরিবর্তে আজীবন রোযা রাখে তবুও ঐ এক রোযার ক্ষতি পূরণ হবে না। (তিরমিযী ৭২৩)

সুতরাং এমন ব্যক্তির সর্ব প্রথম কর্তব্য হলো, আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করা।


সংকলনঃ

মোঃ নাজিমুল হাসান খান
torunsongo@gmail.com

যাকাতের পরিচয়, নিসাব সীমা নির্ধারণ, যাকাত বণ্টনের খাত ও পদ্ধতি ।

আমাদের দেশে স্বর্ণ, রৌপ্য, সম্পদ ও নগদ অর্থের যাকাত দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও অন্যান্য যাকাতযোগ্য মালের অর্থ যথাযথভাবে দান করা হয় না । সামাজিক...