Tuesday, January 7, 2025

মিথ্যার প্রভাব ও মিথ্যাবাদী চেনার উপায়

মিথ্যার সংজ্ঞা:-

প্রসিদ্ধ ও পরিজ্ঞাত বিষয় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। সত্যের বিপরীতই মিথ্যা। যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। এমন কিছু বলা, যা প্রকৃত পক্ষে ঠিক নয় বা সত্য নয় তাই মিথ্যা।

ইচ্ছাকৃত বনাম অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা:-

বিষয়টি সুস্পষ্ট। তবে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে মুসলিম আলিমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের আলিমগণ মনে করতেন যে, ভুলবশত যদি কেউ কোনো কিছু বলেন যা প্রকৃত অবস্থার বিপরীত তবে তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে না। শুধুমাত্র জেনেশুনে মিথ্যা বললেই তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আলিমগণ এ ধারণার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের মতে, না-জেনে বা ভুলে মিথ্যা বললেও তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে।

 

ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) বলেন: ‘‘হক্ক-পন্থী আলিমদের মত হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছায়, ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলাই মিথ্যা।

 

তিনি আরো বলেন: ‘‘আমাদের আহলুস সুন্নাহ-পন্থী আলিমগণের মতে মিথ্যা হলো প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলা, তা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ভুলে হোক। মু’তাযিলাগণের মতে শুধু ইচ্ছাকৃত মিথ্যাই মিথ্যা বলে গণ্য হবে।

 

হাদীসের আলোকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা:-

 

হাদীসের ব্যবহার থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, অজ্ঞতার কারণে বা যে কোনো কারণে বাস্তবের বিপরীত যে কোনো কথা বলাই মিথ্যা বলে গণ্য। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেখুন:-

 

১. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন,

إِنَّ عَبْدًا لِحَاطِبٍ جَاءَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَشْكُو حَاطِبًا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَيَدْخُلَنَّ حَاطِبٌ النَّارَ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم:্রكَذَبْتَ، لاَ يَدْخُلُهَا، فَإِنَّهُ شَهِدَ بَدْرًا وَالْحُدَيْبِيَةَগ্ধ.

হাতিবের (রা) একজন দাস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে রাসূলুল্লাহ ()-এর কাছে এসে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, নিশ্চয় হাতিব জাহান্নামে প্রবেশ করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ () বলেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না; কারণ সে বদর ও হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ছিল।

 

এখানে রাসূলুল্লাহ () হাতিবের এ দাসের কথাকে ‘মিথ্যা’ বলে গণ্য করেছেন। সে অতীতের কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা বলেনি। মূলত সে ভবিষ্যতের বিষয়ে তার একটি ধারণা বলেছে। সে যা বিশ্বাস করেছে তাই বলেছে। তবে যেহেতু তার ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবের বিপরীত সেজন্য রাসূলুল্লাহ () তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অতীত বা ভবিষ্যতের যে কোনো সংবাদ যদি সত্য বা বাস্তবের বিপরীত হয় তাহলে তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে, সংবাদদাতার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অজ্ঞতা বা অন্য কোনো বিষয় এখানে ধর্তব্য নয়। তবে মিথ্যার পাপ বা অপরাধ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত।

 

২. তাবিয়ী সালিম ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, আমার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু উমারকে (রা) বলতে শুনেছি:

بَيْدَاؤُكُمْ هَذِهِ الَّتِى تَكْذِبُونَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ فِيهَا مَا أَهَلَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ مِنْ عِنْدِ الْمَسْجِدِ يَعْنِى ذَا الْحُلَيْفَةِ

এ হলো তোমাদের বাইদা প্রান্তর, যে প্রান্তরের বিষয়ে তোমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বল (তিনি এ স্থান থেকে হজ্জের ইহরাম শুরু করেছিলেন বলে তোমরা বল।) অথচ রাসূলুল্লাহ যুল হুলাইফার মসজিদের কাছ থেকে হজ্জের ইহরাম করেছিলেন।

 

স্বভাবতই ইবনু উমার (রা) এসকল ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার অভিযোগ করছেন না। রাসূলুল্লাহ বিদায় হজ্জের সময় লক্ষাধিক সাহাবীকে সাথে নিয়ে হজ্জ আদায় করেন। তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে ‘যুল হুলাইফা’ প্রান্তরে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন সকালে সেখান থেকে হজ্জের ইহরাম করেন। যুল হুলাইফা প্রান্তরের সংলগ্ন ‘বাইদা’ প্রান্তর। যে সকল সাহাবী কিছু দূরে ছিলেন তাঁরা তাঁকে যুল হুলাইফা থেকে ইহরাম বলতে শুনেন নি, বরং বাইদা প্রান্তরে তাঁকে তালবিয়া পাঠ করতে শুনেন। তাঁরা মনে করেন যে, তিনি বাইদা থেকেই ইহরাম শুরু করেন। একারণে অনেকের মধ্যে প্রচারিত ছিল যে, রাসূলুল্লাহ বাইদা প্রান্তর থেকে ইহরাম শুরু করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার যেহেতু কাছেই ছিলেন, সেহেতু তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন।

 

এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইদা থেকে ইহরাম করার তথ্যটি ছিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভুল। যারা তথ্যটি প্রদান করেছেন তারা তাদের জ্ঞাতসারে সত্যই বলেছেন। কিন্তু তথ্যটি যেহেতু বাস্তবের বিপরীত এজন্য ইবনু উমার (রা) তাকে ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন।

মিথ্যা বনাম ‘মাউদূ’ (মাউযূ) ও ‘বাতিল’

 

হাদীসের পরিভাষায় ও ১ম শতকে সাহাবী-তাবিয়ীগণের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে কথিত মিথ্যাকে حديث كذب বা ‘মিথ্যা হাদীস’ বলে অভিহিত করা হতো। আবু উমামাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন:

مَنْ حَدَّثَ عَنِّيْ حَدِيْثاً كَذِباً مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ

যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।

যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি তা তাঁর নামে বলা হলে সাহাবী ও তাবিয়িগণ বলতেন: ‘هذا الحديث كذب’ এ হাদীসটি মিথ্যা, ‘حديث كذب’ মিথ্যা হাদীস বা অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করতেন। এ ধরনের মানুষদের সম্পর্কে ‘মিথ্যাবাদী’ (كذّاب), ‘সে মিথ্যা বলে’ (يكذب) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন।

 

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীসের নামে মিথ্যার প্রসারের সাথে সাথে এ সকল মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করতে মুহাদ্দিসগণ ‘মিথ্যা’-র সমার্থক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। শব্দটি ‘الوضع’। শব্দটির মূল অর্থ নামানো, ফেলে দেয়া, জন্ম দেয়া। বানোয়াটি অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে: To lay, lay off, lay on, lay down, put down, set up... give birth, produce ...humiliate, to be low, humble...

 

পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এ শব্দের ব্যবহারই ব্যাপকতা লাভ করে। তাঁদের পরিভাষায় হাদীসের নামে মিথ্যা বলাকে ‘ওয়াদউ’ (وضع) এবং এধরনের মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউদূ’ (موضوع) বলা হয়। ফার্সী-উর্দু প্রভাবিত বাংলা উচ্চারণে আমরা সাধারণত বলি ‘মাউযূ’।

 

অনেক মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। উভয় প্রকার মিথ্যা হাদীসকেই তাঁরা মাউদূ (موضوع) হাদীস বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় আমরা মাউদূ (মাউযূ) অর্থ বানোয়াট বা জাল বলতে পারি।

 

মুহাদ্দিসগণ মাউযূ (মাউদূ) হাদীসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন দু’ভাবে: অনেক মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: ‘المختلق المصنوع’ ‘‘বানোয়াট জাল হাদীসকে মাউযূ হাদীস বলা হয়।’’ এখানে তাঁরা হাদীসের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

 

অন্যান্য মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: (ما تفرد بروايته كذاب) ‘‘যে হাদীস কোনো মিথ্যাবাদী রাবী একাই বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস। এখানে তাঁরা মাউযূ বা জাল হাদীসের সাধারণ পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার (Cross Examine) মাধ্যমে রাবীর সত্য-মিথ্যা যাচাই করতেন। নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, কোনো একটি হাদীস একজন মিথ্যাবাদী ব্যক্তি ছাড়া কেউ বর্ণনা করছেন না তবে তাঁরা হাদীসটিকে মিথ্যা বা মাউযূ বলে গণ্য করতেন।

 

কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘বাতিল’ (باطل) ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘মাউযূ’ বা ‘মাউদূ’ (موضوع) বলে অভিহিত করেছেন। নিরীক্ষা মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ বলেন নি, কিন্তু ভুল করে তাঁর নামে বলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা সে হাদীসটিকে ‘বাতিল’ বলে অভিহিত করেন। আর যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ইচ্ছাপূর্বক বা জ্ঞাতসারে এ কথাটি রাসূলুল্লাহ -এর নামে বলেছে, তাহলে তাঁরা একে ‘মাউযূ’ নামে আখ্যায়িত করেন।

 

মিথ্যা হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ প্রথম পদ্ধতিরই অনুসরণ করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার মিথ্যাকেই ‘মাউযূ’ (موضوع) বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি বা যে কর্ম তিনি করেন নি, অথচ তাঁর নামে কথিত বা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ওহীর নামে জালিয়াতি রোধ করা। বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাটি বলেছেন, না ভুলক্রমে তা বলেছেন সে বিষয় তাঁদের বিবেচ্য নয়। এ বিষয় বিবেচনার জন্য রিজাল ও জারহ ওয়াত্ তা’দীল শাস্ত্রে পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে।

 

মিথ্যাবাদী চেনার সহজ উপায়:-

 

সামাজিক কোনও বিষয়ের কথা এলে দেখা যায় মিথ্যার অস্তিত্ব থাকতে পারে কিংবা অন্তত সাদাসিধে কিছু নির্দোষ মিথ্যা-যা হয়তো সমাজে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।

এবং যদিও আমরা মিথ্যা ধরে ফেলতে খুব দক্ষ নই, কিন্তু তারপরও কিছু সহজ উপায় আছে যা হয়তো আপনাকে কোনটি মিথ্যা তা সহজে বুঝতে সাহায্য করবে...

 

মানুষের এবং প্রাণী জগতের মধ্যে বিদ্যমান অসদাচরণের পেছনে কি কারণ তা অনুসন্ধানের জন্য গবেষণা শুরু করেন জীববিজ্ঞানী এবং লেখক লুসি কুক।

 

প্রায়ই লোকজন যখন তাদের কথা বা কাজ দিয়ে আমাদের প্রতারিত করার চেষ্টা করে তখন আমরা তাকে বলি মিথ্যাচার।। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাধারণ কথাবার্তায় সেটা ঘটতে পারে কারণ যেটা আমরা সত্যিকারে ভাবি সেটা কিন্তু আমরা বলি না।

 

কল্পনা করুন তো, প্রতিটি আড্ডায়, আপনার সাথে যাদের আলাপ হয়েছে তাদের যদি আপনি বলেন, আপনার সম্পর্কে এবং আপনার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে তাদের সত্যিকার ভাবনা কি- সেটা জানাতে? সেটা হবে প্রচণ্ড অসহনীয়।

 

এমনকি যদি কারো অনেক টাকা দিয়ে করা নতুন হেয়ার স্টাইল দেখে তা আমাদের পছন্দ নাও হয় তবুও আমাদের বেশিরভাগই তা প্রকাশ করার দু:স্বপ্ন দেখবে না।

 

আমাদের বিবেচনা বলে যে, একশো ভাগ সত্যবাদী হওয়ার ফলে ভালোর চেয়ে তা ক্ষতিই করতে পারে এবং এইরকম পারস্পরিক সহযোগিতার আদান-প্রদানই মানুষের সামাজিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু ।

 

হ্যাঁ এভাবে প্রবঞ্চনা বা মিথ্যাচার হলো এক ধরনের আঠা যা আমাদের একে অপরের সাথে যুক্ত রাখে, সহযোগিতার চাকায় তেল দেয় এবং বিশ্বকে রাখে বন্ধুত্বপূর্ণ ও শান্তিময়।

“প্রতিদিনই জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ গুরুতর মিথ্যা বলে” - মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেছেন।

 

এবং যদিও সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, পাঁচ শতাংশ মানুষ দাবি করেছে যে তারা কখনোই মিথ্যা বলেনি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে আমাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করে চালানো জরিপেও সত্যি বলতে অপারগ...

 

মিথ্যা শনাক্তকরণে বিচারকদের চেয়ে কয়েদীরা এগিয়ে--- মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেন, "আমরা মিথ্যা বলায় বেশ ভালো, মিথ্যা শনাক্ত করণে বেশ বাজে"।


আমরা মনে করি যে প্রতারণা ধরে ফেলতে আমরা বেশ দক্ষ, কিন্তু যখন দুইজন মানুষকে আপনি গবেষণাগারে নিয়ে যাবেন এবং একটি ভিডিও দেখাবেন যেখানে একজন মানুষ মিথ্যা বলছেন এবং আরেকটিতে তারা সত্যি কথা বলছে- এরপর যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন কোনটা কি-তখন তাদের মধ্যে কেবল ৫০ শতাংশ মানুষ সঠিকভাবে বলতে পারবে।

 

মিথ্যা ধরে ফেলতে আমরা খুব একটা দক্ষ নই কারণ আমরা সব চাক্ষুষ করে বা চোখ দিয়ে দেখে তারপর বিচার-বিবেচনা করি। আমাদের ব্রেইনের বিশাল অংশ নিয়োজিত রয়েছে দৃষ্টিগোচর করার কাজে এবং সে কারণে কেউ মিথ্যা বলছে কিনা তা সনাক্ত করার জন্য আমরা এভাবেই বোঝার চেষ্টা করি।

 

তারা কি তাদের বসার আসনের চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে? তারা কি ইঙ্গিত করছে? তাদের মুখের ভঙ্গি কেমন?

 

এর অধিকাংশ বিষয় মোটামুটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সুদক্ষ মিথ্যাবাদীরা জানে অন্য লোকেরা কিভাবে চেষ্টা করে এবং মিথ্যা ধরে ফেলতে চায়।

 

আমরা যা বলি এবং যেভাবে বলি। এটা নিয়ন্ত্রণ করা মিথ্যাবাদীদের জন্য বেশ কঠিন -সুতরাং সেদিকে যদি আপনি নিজের মনোযোগ দেন তাহলে আপনি হবেন আরও ভালো মিথ্যা শনাক্তকারী।

 

যারা মিথ্যাবাদী তারা সাধারণভাবে কম কথা বলে; তারা একটি প্রশ্নের পর উত্তর দিতে দীর্ঘ সময় নেয়; এবং তারা মিথ্যা থেকে নিজেদের দূরত্ব দেখাতে চায়: তাই "আমি", "আমার" এবং "আমি" শব্দগুলো প্রায়শই বাদ পড়ে যায়।

যদি আপনি দক্ষ মিথ্যাবাদী হন, তাহলে কপালে 'কিউ' লিখুন

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ একে অপরের চেয়ে বেশি মিথ্যা বলতে ওস্তাদ, এবং রিচার্ড ওয়াইজম্যান দুটি গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য একটি পরীক্ষা চালান। এটাকে বলে "কিউ" টেস্ট এবং এটা সম্পন্ন করার জন্য মাত্র ৫ সেকেন্ড সময় লাগে।

 

আপনার তর্জনী আঙ্গুল হাতের ওপর রাখুন এবং কপালের ওপর বড় হাতের "কিউ" আঁকুন। প্রশ্ন হল, কিউ'র লেজের অংশটি কি আপনার ডান চোখের ওপরে পড়েছে? নাকি বা চোখের ওপরে? অন্য কথায়,আপনি কি "কিউ" এমনভাবে লিখেছেন যাতে করে কেউ আপনার দিকে তাকালে সেটি পড়তে পারে? নাকি যাতে আপনি নিজেই সেটি পড়তে পারেন?

 

এই তত্ত্বের মানে হল যে, যদি "কিউর লেজ বাম চোখের ওপরে থাকে - তাহলে আপনার দিকে তাকালে লোকজন সেটা পড়তে পারে- সর্বদা আপনি ভাবছেন যে অন্যান্য লোকেরা আপনাকে কিভাবে দেখছে এবং সুতরাং আপনি একজন দক্ষ মিথ্যাবাদী হবেন।

 

কিন্তু যদি সেটি আপনি ডান চোখের বরাবর রাখেন তাহলে বুঝতে হবে যে আপনি বিশ্বকে দেখছেন আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে -আপনার মধ্যে সততার প্রতি একটু বেশি ঝোঁক আছে।

 

সব জায়গাতেই প্রতারণা। প্রাকৃতিক পৃথিবীতে প্রাণীকুল ছদ্মবেশ এবং ব্যবহার দ্বারা প্রতিনিয়ত একজন আরেকজনকে প্রতারণা করে যাচ্ছে ।

 

ধরা যাক সামুদ্রিক মাছ স্কুইডের কথাই, যেটি শিকারীর থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে, কেবল নিজের দেহের একপাশে যৌন সংকেত পাঠিয়ে যা তার প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে নিজেকে গোপন রাখে।

 

মানুষ/ বাচ্চারা কখন মিথ্যাচার শুরু করে?

 

"আপনি শিশুদের একটি কক্ষে নিয়ে যাবেন, এবং তাদের বলবেন, 'আমরা তোমার প্রিয় খেলনা তোমার পেছনে রেখে দেবো, কিন্তু প্লিজ তাকাবে না'- এবং এরপর আপনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবেন এবং তাদের আবারো মনে করিয়ে দিন খেলনার দিকে না তাকাতে"।

যেহেতু কোনও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড আপনি প্রত্যক্ষ করবেন, আপনি বুঝতে পারবেন যে, কয়েক মিনিট পরেই তারা খেলনার দিকে তাকাবে।

এরপর কক্ষে ফিরে গিয়ে তাদের কাছে জানতে চান, "তোমরা কি খেলনার দিকে তাকিয়েছিলে?"

"যখন তিন বছর বয়সী বাচ্চাদের সাথে আপনি এই টেস্ট করবেন এবং যে বয়সে তারা কথাবার্তায় পাকা হতে শুরু করেছে- দেখবেন ইতোমধ্যে তাদের ৫০শতাংশই মিথ্যে বলছে"-বলেন গবেষক রিচার্ড। "আর যখন তাদের বয়স পাঁচ বছরে পৌঁছাবে তখন তাদের একজনও সত্যি কথা বলবে না!"

 

মিথ্যার কিছু রূপ:-

 

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنّ الْبِرّ يَهْدِي إِلَى الْجَنّةِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرّى الصِّدْقَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِيّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النّارِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرّى الْكَذِبَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذّابًا.

তোমরা সত্যকে অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো কাজে উপনীত করে। আর ভালো কাজ উপনীত করে জান্নাতে। মানুষ সত্য বলে ও সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকে, একপর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।

আর তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা উপনীত করে পাপাচারে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬০৭

 

হাদীসের অর্থ একেবারেই সরল। মর্ম খুবই প্রাঞ্জল। অর্থাৎ সত্যবাদিতা যেমন একটি ভালো গুণ, তার বৈশিষ্ট্য হল, মানব-জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি ভালো প্রভাব সৃষ্টি করে, ভালোর দিকে পরিচালিত করে। ফলে লোকটির ঠিকানা হয় জান্নাত। পক্ষান্তরে মিথ্যা খোদ একটি মন্দ ও ঘৃণিত স্বভাব। সাথে তার একটি মন্দ প্রতিক্রিয়া এ-ও যে, এটি মানুষের মধ্যে পাপাচার ও অবাধ্যতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। পুরো জীবনটাকে অন্যায় ও অনাচারে কলুষিত করে তোলে। ফলে তার পরিণতি হয় জাহান্নাম। (দ্র. মিরকাতুল মাফাতীহ ৯/১৪০ মাআরেফুল হাদীস, মনযুর নুমানী, হাদীস ১৯৪)

আরেকটি হাদীসে এসেছে-

يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى الْخِلَالِ كُلِّهَا إِلّا الْخِيَانَةَ وَالْكَذِبَ

قال الزرقاني في الشرح على المؤطا: وَضَعّفَ الْبَيْهَقِيّ رَفْعَهُ، وَقَالَ الدّارَقُطْنِيّ: الْمَوْقُوفُ أَشْبَهُ بِالصّوَابِ، قَالَ غَيْرُهُ: وَمَعَ ذَلِكَ فَحُكْمُهُ الرّفْعُ عَلَى الصّحِيحِ ; لِأَنّهُ مِمّا لَا مَجَالَ لِلرّأْيِ فِيهِ، انْتَهَى.

মুমিনের চরিত্রে সবকিছুর অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু প্রতারণা ও মিথ্যা নয়। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬১২১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৭০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৪৬৯

 

অর্থাৎ কেউ যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা তার মধ্যে হয়ত থাকতে পারে, কিন্তু মিথ্যা ও খেয়ানতের কোনো অংশ তার চরিত্রে জায়গা করতে পারে না। ঈমানের সাথে মিথ্যা ও খেয়ানতের মতো মুনাফিকসুলভ বিষয় একত্রিত হতে পারে না। কাজেই কারো মধ্যে যদি মিথ্যা এবং প্রতারণার মতো মন্দ কোনো স্বভাব থাকে, বুঝতে হবে ঈমানের হাকীকত এখনও তার অর্জিত হয়নি। (দ্র. মাআরেফুল হাদীস)

মিথ্যার রয়েছে বহু ক্ষেত্র। ইসলামী শরীয়তে সবিস্তারে মিথ্যার পরিধি বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কিছু মিথ্যা আছে, যেগুলোকে অনেকসময় মিথ্যাও মনে করা হয় না। ইসলাম সেগুলো থেকেও বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নিম্নে মিথ্যার অবহেলিত কিছু দিক তুলে ধরা হল।

 

যাচাই-বাছাই ছাড়া বলা ও প্রচার করাও মিথ্যা

মিথ্যার একটি সূক্ষ্ম রূপ, যাচাই-বাছাই ছাড়া যা শোনে তাই বলে বেড়ানো। কারণ এর মাধ্যমে অনায়াসেই একটি ভুল তথ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْۤا اَنْ تُصِیْبُوْا قَوْمًۢا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوْا عَلٰی مَا فَعَلْتُمْ نٰدِمِیْنَ.

হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবসত কোনো সম্পদ্রায়ের ক্ষতি না করে বস! ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের আনুতপ্ত হতে হয়। সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৬

হাদীসে এসেছে-

كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.

কারো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (কোনো বাছ-বিচার ছাড়া) তাই প্রচার করতে থাকে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯২

 

আর যদি দ্বীনী বিষয় হয় তখন তো ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়! পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘আলকাযিবু আলাল্লাহি ওয়া রাসূলিহি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে মিথ্যা বলা। কারণ এর মাধ্যমে শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যা  প্রকাশিত হয়। এর দায় কখনো ওই ব্যক্তি এড়াতে পারে না, যার অসতর্কতার কারণে এই ভুল তথ্যটি প্রচারিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসযে আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়!সহীহ বুখারী, হাদীস ১০৭

 

কোনো বর্ণনায় আছেযে ইচ্ছাকৃতআমার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে...।বলা বাহুল্য, অসাবধানতা, অসতর্কতা, যাচাই-বাছাই ছাড়া দ্বীনের ব্যাপারে বেপরোয়া ও বল্গাহীন বলতে থাকাও প্রকারান্তরে ইচ্ছাকৃত বলার শামিল। তাই  স্যোশাল মিডিয়া বা অন্য কোনো মাধ্যমে মুখরোচক যা শোনে তা-ই প্রচার করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা কাম্য।

 

গণমাধ্যমে মিথ্যা

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির তথা বিশ্ব মানব কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আবার মিথ্যা, অবাস্তব ও বানোয়াট সংবাদ প্রচারের কারণে অশান্তি ও অস্থীতিশীলতাও তৈরি হয়। এখানে যে মিথ্যা প্রচার করা হয় তা সারা দেশে, সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায় এবং এর কারণে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে এমন ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারের শাস্তি অনেক ভয়াবহ।

মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দেখানো হল। তার মধ্যে ছিল এক লোক বসা, পাশে আরেকজন দাঁড়ানো। তার হাতে লোহার পেরেক। লোহার পেরেক দিয়ে এই লোক পাশের লোকটির চোয়ালে আঘাত করে এবং পেরেকটি তার চোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে অপর চোয়ালে আঘাত করে। ততক্ষণে আগের চোয়াল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং সে আবার আঘাত করতে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হল, এরা কারা? বলা হল, সামনে চলো। (এভাবে অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তিও দেখানো হল। পরিশেষে যখন একে একে সবার শাস্তির কারণ জানানো হল, তখন বলা হল)

أَمّا الّذِي رَأَيْتَهُ يُشَقّ شِدْقُهُ، فَكَذّابٌ يُحَدِّثُ بِالكَذْبَةِ، فَتُحْمَلُ عَنْهُ حَتّى تَبْلُغَ الآفَاقَ، فَيُصْنَعُ بِهِ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ.

আঘাত করে করে যার চোয়াল বিদীর্ণ করে ফেলতে দেখেছেন, সে ছিল মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলত (এবং তা প্রচার করত) ফলে তার বলা মিথ্যা প্রচার হতে হতে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ত। কাজেই কিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এমনটি করা হতে থাকবে, এভাবেই তাকে শাস্তি দেয়া হবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৬

 

সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যা

ইসলামে সত্য সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের হক ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে সামান্য হেরফেরের মাধ্যমেও অন্যের উপর বড় ধরনের জুলুম হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় অন্যের সম্পদ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গোনাহও সংঘটিত হয়ে যায় এই মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে। তাই ইসলাম সত্য সাক্ষ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছে। একান্ত ওজর না থাকলে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকতেও নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ ؕ وَ مَنْ یَّكْتُمْهَا فَاِنَّهٗۤ اٰثِمٌ قَلْبُهٗ.

তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। সূরা বাকারা (২) : ২৮৩

 

বিপরীতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যাপারে রয়েছে কঠিন হুমকি-বাণী। সবথেকে বড় গোনাহগুলোর মধ্যে রাখা হয়েছে এই মিথ্যা সাক্ষ্যকে। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বড় (কবীরা) গোনাহগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৫৩

 

মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় গোনাহ। এর মাধ্যমে অনেকসময় নিরাপরাধ মানুষ নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়। হতে হয় মিথ্যা হয়রানির শিকার।

 

অনুরূপ মিথ্যা শপথের ব্যাপারেও হাদীসে কঠিন ধমকি এসেছেযে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য বিচারকের সামনে মিথ্যা শপথ করবে, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এই অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তিনি তার উপর খুবই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত থাকবেন।সহীহ বুখারী, হাদীস ৪২৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২

 

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে কোনো মুসলমানের হক বিনষ্ট করল, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেবেন এবং জান্নাত তার উপর হারাম করে দেবেন। একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেটা যদি কোনো সামান্য জিনিসও হয়? (অর্থাৎ কেউ যদি কারো সামান্য ও তুচ্ছ জিনিসও কসম খেয়ে আত্মসাৎ করে, তারও কি এই পরিণতি হবে?) উত্তরে নবীজী বললেন-

وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ.

হাঁ, যদি সেটা পিলু বৃক্ষের একটি ডালও হয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৭

 

ব্যবসায় মিথ্যা

ব্যবসা হালাল উপার্জনের একটি উত্তম উপায়। সাহাবীগণ ব্যবসা করেছেন। কেউ যদি ব্যবসা  করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া বিধি-বিধান পালন করে, সততা ও আমানতদারি রক্ষা করে, এর মাধ্যমে দুনিয়াতেও যেমন তার জন্য রয়েছে শান্তি ও সমৃদ্ধি, পরকালেও রয়েছে অনেক মর্যাদা ও পুরস্কার।

হাদীস শরীফে এসেছে-

التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشّهَدَاءِ.

সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (আখেরাতে) নবী-রাসূল, সিদ্দীক ও শহীদদের সাথে থাকবে। জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২১৪৩

 

ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেকসময় খুব সাধারণভাবেই মুখে মিথ্যা চলে আসে। মিথ্যার ধরনটা হলভাই! মাত্র পাঁচ টাকা লাভ করছি! বরং আপনাকে কেনা দামেই ছেড়ে দিচ্ছি! এটাই সবচেয়ে ভালো কোম্পানির; এর চেয়ে ভালো আপনি আর কোথাও পাবেন না!ইত্যাদি বাক্য মুখে মুখে থাকে! অথচ এখানে কেবল কি মিথ্যা? ধোঁকা, প্রতারণা ও খেয়ানতের মতো বড় বড় অনেকগুলো গোনাহের সমাবেশ ঘটে! বিশেষত ধোঁকা ও প্রতারণার বিষয়টি তো একেবারে স্পষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

যে আমাদের (মুসলমানদেরকে) ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত (মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত) নয়।

এই হুমকি-বাণীর প্রেক্ষাপটটিও কিন্তু ব্যবসা কেন্দ্রিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একজন শস্যব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তার শস্যের স্তুপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের শস্যগুলোতে কিছুটা আর্দ্রতা অনুভব করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? ব্যবসায়ী উত্তর দিল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। নবীজী বললেন, ভেজা অংশটা উপরে রাখলে না কেন? এরপর নবীজী বললেন-

مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي.

যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত (মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত) নয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৪৮৯

 

মিথ্যা বলে গ্রাহককে ত্রুটিযুক্ত পণ্য ধরিয়ে দেয়া-

 

মিথ্যা বলে গ্রাহককে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ত্রুটিযুক্ত পণ্যটি ধরিয়ে দেয়ার মধ্যে বড় ধরনের খেয়ানত বিদ্যমান। হাদীসে এসেছে-

كَبُرَتْ خِيَانَةً تُحَدِّثُ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ بِهِ كَاذِبٌ.

এটা অনেক বড় খেয়ানত যে, তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বলছ, সে এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছে, অথচ তুমি এতে মিথ্যাবাদী। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৬৩৫; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৩৯৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৭১

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, তিন ধরনের ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দয়া-দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এদের অন্যতম হল-

وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.

যে মিথ্যা কসম খেয়ে নিজের পণ্য চালিয়ে দেয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৬

 

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে, অনেকসময় রাজনৈতিকভাবেও জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়। যাকে কেবল কবীরা গোনাহই নয়, হাদীসে মুনাফিকের স্বভাব বলা হয়েছে। হাদীসে মুনাফিকের একটি নিদর্শন বলা হয়েছেÑ-

وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ.

মুনাফেকের একটি নিদর্শন হল, ওয়াদা করে ভঙ্গ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭

অন্য হাদীসে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.

মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি; কথা বললে মিথ্যা বলে। ওয়াদা করে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯

 

শিশুদের সাথে মিথ্যা

বাচ্চাদের সাথে কৌতুক, তাদের মন ভুলানো বা তাদের কান্না থামানোর জন্য তাদেরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেয়া হয়ে থাকে। যা কেবল গোনাহই নয়, পাশাপাশি আরো অনেক ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে! কারণ এর মাধ্যমে শিশুর কোমল অনুভূতিতে মিথ্যার মতো অপরাধকে হালকা করে দেয়া হল এবং তার স্বভাবে অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দেয়া হল। প্রকারান্তরে তাকে এই অপরাধটির প্রতি উৎসাহিত করা হল।

 

সুন্দর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। নবী-যুগের ঘটনা। আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন আমি ছিলাম ছোট্ট শিশু। খেলতে বের হচ্ছিলাম। আম্মা আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, এদিকে এসো, তোমাকে একটা জিনিস দেব। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কী দেয়ার ইচ্ছা করেছ? আম্মা বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দেয়ার ইচ্ছা করেছি। নবীজী বললেন-

أَما إِنّكِ لَوْ لَمْ تُعْطِيهِ شَيْئًا كُتِبَتْ عَلَيْكِ كِذْبَةٌ.

মনে রেখো! যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গোনাহ লিখে দেয়া হত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯১

 

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قَالَ لِصَبِيٍّ: تَعَالَ هَاكَ، ثُمَّ لَمْ يُعْطِهِ فَهِيَ كَذْبَةٌ.

যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে বলল, এসো তোমাকে (এটা-সেটা) দিব। তারপর দিল না; এটিও একটি মিথ্যা। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৮৩৬; আয্যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদীস ৩৭৫

 

বন্ধুদের সাথে মিথ্যা

বন্ধুদের আড্ডা ও হাস্যরসের আসরগুলোও যেন মিথ্যা ছাড়া জমে না। রসিয়ে রসিয়ে এবং মিথ্যার মিশেলে যে যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে এবং বন্ধুদের হাসাতে পারে, সে তত বাহবা পায়!

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ-

وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ، لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ.

ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা বলে! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০০৪৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯০

 

এখানে মিথ্যার কিছু রূপ তুলে ধরা হল। এছাড়াও মিথ্যার আরও বহু ক্ষেত্র ও রূপ রয়েছে। অর্থাৎ মিথ্যা যেমন হতে পারে কথায়, তেমনি হতে পারে লেখায়ও। জাল সার্টিফিকেট, মিথ্যা দলিলপত্র ও সনদপত্র ইত্যাদি সবই এর আওতাভুক্ত।

 

আমাদের উচিত, সকল ধরনের মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা। সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। ভালো স্বভাবগুলোর উৎস। মিথ্যা একটি সর্বজনবিদিত অপরাধ। যা কেবল ব্যক্তির পরকালকেই বরবাদ করে না, তার ব্যক্তিত্বকেও ধ্বংস করে। মানুষের আস্থা, ভালবাসা, আন্তরিকতার জায়গাটা তখন আহত হয়। ডেকে আনে ক্ষতি আর ক্ষতি। ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যাকে নগদ লাভ মনে হলেও এর রয়েছে কঠিন পরিণতি।

 

 মিথ্যার বিধান:-

ওহী বা হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনার আগে আমরা সাধারণভাবে মিথ্যার বিধান আলোচনা করতে চাই। মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এজন্য সকল মানব সমাজে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে মিথ্যাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদিগক সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ ও কঠিন শাস্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সার্বক্ষণিক সত্যবাদিতার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ- সুবহানাহু- বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।

মিথ্যার ভয়ানক শাস্তির বিষয়ে আল্লাহ-সুবহানাহু- বলেছেন:

فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যা বলত।

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَى يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

পরিণামে তিনি (আল্লাহ) তাদের অন্তরে কপটতা স্থিত করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর কাছে যে অঙ্গীকার করেছিল তা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।

 

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ

আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।

 

অগণিত হাদীসে মিথ্যাকে ভয়ঙ্কর পাপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ (الصِّدْقُ بِرٌّ) وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ (لَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ) حَتَّى يُكْتَبَ (عِنْدَ اللهِ) صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ (الْكَذِبُ فُجُوْرٌ) وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ (لَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ) حَتَّى يُكْتَبَ (عِنْدَ اللَّهِ) كَذَّابًا

সত্য পুণ্য। সত্য পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে এবং পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষটি সদা সর্বদা সত্য বলতে সচেষ্ট থাকেন তিনি একপর্যায়ে আল্লাহর কাছে ‘সিদ্দীক’ বা মহা-সত্যবাদী বলে লিপিবদ্ধ হন। আর মিথ্যা পাপ। মিথ্যা পাপের দিকে পরিচালিত করে। আর পাপ জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষটি মিথ্যা বলে বা মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে সে এক পর্যায়ে মহা-মিথ্যাবাদী বলে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

 

হাদীসে মিথ্যা বলাকে মুনাফিকীর অন্যতম চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে যে, মুমিন অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু মিথ্যা বলতে পারে না। সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন

يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى كُلِّ خَلَّةٍ غَيْرَ الْخِيَانَةِ وَالْكَذِبِ

মুমিনের প্রকৃতিতে সব অভ্যাস থাকতে পারে, কিন্তু খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যা থাকতে পারে না।

 

আল্লাহর নামে মিথ্যা ও আন্দায কথার নিষেধাজ্ঞা:-

 

কুরআন বারবার আল্লাহর নামে মিথ্যা বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। অনুরূপভাবে না-জেনে, আন্দাজে, ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহর নামে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ -এর নামে মিথ্যা বলার অর্থ আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা। কারণ রাসূলুল্লাহ আল্লাহর পক্ষ থেকেই কথা বলেন। কুরআনের মত হাদীসও আল্লাহর ওহী। কুরআন ও হাদীস, উভয় প্রকারের ওহীই একমাত্র রাসূলুল্লাহ -এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী পেয়েছে। কাজেই রাসূলুল্লাহ -এর নামে কোনো প্রকারের মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলার অর্থই আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা বা না-জেনে আল্লাহর নামে কিছু বলা। কুরআন কারীমে এ বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি।

 

১. কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে:

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا

আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সম্পর্কে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে?

২. অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَيْلَكُمْ لا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى

দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। করলে, তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে।

৩. কুরআন কারীমে বারংবার না-জেনে, আন্দাজে বা অনুমান নির্ভর করে আল্লাহ, আল্লাহর দীন, বিধান ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে বলা করা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الأَرْضِ حَلالا طَيِّبًا وَلا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কার্যের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যা জান না এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়।

 

৪. অন্যত্র আল্লাহ-সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা- বলেন:

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

বল, ‘আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরীক করা, যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেন নি, এবং আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।

 

এভাবে কুরআনে ওহীর জ্ঞানকে ভেজাল ও মিথ্যা থেকে রক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ, তাঁর প্রিয় রাসূল (), তাঁর দীন, তাঁর বিধান ইত্যাদি কোনো বিষয়ে মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলা কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

 

তথ্য গ্রহণের পূর্বে যাচাইয়ের নির্দেশ:-

 

নিজে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল ()-এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের কোনো অনির্ভরযোগ্য, মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর বর্ণনা বা বক্তব্য গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। যে কোনো সংবাদ বা বক্তব্য গ্রহণে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

‘‘হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপী তোমাদের কাছে কোনো খবর আনে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্থ না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’’

 

এ নির্দেশের আলোকে, কেউ কোনো সাক্ষ্য বা তথ্য প্রদান করলে তা গ্রহণের পূর্বে সে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সততা ও তথ্য প্রদানে তার নির্ভুলতা যাচাই করা মুসলিমের জন্য ফরয। জাগতিক সকল বিষয়ের চেয়েও বেশি সতর্কতা ও পরীক্ষা করা প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ () বিষয়ক বার্তা বা বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে। কারণ জাগতিক বিষয়ে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের সম্পদ, সম্ভ্রম বা জীবনের ক্ষতি হতে পারে। আর রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীস বা ওহীর জ্ঞানের বিষয়ে অসতর্কতার পরিণতি ঈমানের ক্ষতি ও আখিরাতের অনন্ত জীবনের ধ্বংস। এজন্য মুসলিম উম্মাহ সর্বদা সকল তথ্য, হাদীস ও বর্ণনা পরীক্ষা করে গ্রহণ করেছেন।

 

মিথ্যা বলার ক্ষতি ও ভয়াবহতা:-

 

মিথ্যা বলার প্রধান কারণ হলো, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি, অনৈতিক সুবিধা লাভের চিন্তা, অতিরিক্ত রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হওয়া, নিজের প্রতি অন্যদের আকর্ষণ করা, নিজেকে বড় বলে জাহির করা ইত্যাদি। মিথ্যা বলা ইসলামে বড় অন্যায় কাজ। একটি মিথ্যা, আরেকটি মিথ্যাকে টেনে আনে এবং সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলার পথ তৈরি করে। এখানে মিথ্যা বলার কয়েকটি ক্ষতি ও ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হলো:

 

মিথ্যা বলার ক্ষতি-

  • মিথ্যা সত্য গ্রহণ করার মনমানসিকতা লুপ্ত করে দেয়। 
  • মিথ্যা বিভিন্ন ধরনের গুনাহের পথ তৈরি করে দেয়। 
  • একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার জন্ম দেয়। 
  • মিথ্যা দায়িত্বজ্ঞান কমিয়ে দেয়। 
  • মিথ্যা আল্লাহর রহমত ও হেদায়াত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। 

 

মিথ্যার ভয়াবহতা-

  • পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তারাই মিথ্যা আরোপ করে, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে না এবং প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী।’ (সুরা নাহল: ১০৫) 
  • হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, ‘মুনাফেকির দরজাগুলোর অন্যতম হলো মিথ্যা।’ (তানবিহ আল-খাওয়াতির: ৯২) 
  • নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলো এবং সে তোমাকে বিশ্বাস করে অথচ তুমি তাকে মিথ্যা বলছ—এটি বড় বিশ্বাসঘাতকতা।’ (আত-তারগিব: ৩/৫৯৬) 
  • নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মিথ্যা থেকে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা ইমান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।’ (কানজুল উম্মাল: ৩/৮২০৬) 
  • নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা মিথ্যাবাদী থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।’ (তিরমিজি: ১৯৭২) 

 

মুসলমানের জীবনে সত্য-মিথ্যার প্রভাব :-

 

সবাইকে সত্যবাদী হওয়ার ব্যাপারে বেশি বেশি সতর্ক করা প্রয়োজন। জন্মের পর ছোট ছোট সন্তানদের সামনেই পিতা-মাতা অনর্গল মিথ্যা বলে চলেছেন। মিথ্যা বলাটা যেন এখন ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। সততায় অন্তরের প্রশান্তি। নাজাত লাভ, জান্নাত অর্জন, খোদার সন্তুষ্টি এবং ধনসম্পদেও বরকতের মাধ্যম। সততা মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ। মানবজীবনে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

 

মানব সমাজকে যে সীমারেখায় চলতে নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। এগুলোর মধ্যে সততা অন্যতম। সততা ও স্বচ্ছতা নবী, আওলিয়া, ফেরেশতা, পীর-বুজুর্গ, নেককার ব্যক্তি সবার গুণ এটি। শুধু মুসলমান কেন বরং প্রত্যেক মানুষ- চাই সে মুমিন হোক বা কাফের, নেককার হোক বা বদকার। অফিসার হোক বা কর্মী। শিক্ষক হোক বা ছাত্র। পীর হোক বা মুরিদ।

 

ধনী হোক বা গরিব, পিতা-মাতা হোক বা সন্তানাদী। মোটকথা মানবজীবনের প্রতিটি সেক্টরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো সততা। মানব সমাজের নিরাপত্তা, প্রশান্তি, সুখ-শান্তি, বিনির্মাণ, উন্নতির ভিত্তি হলো সততা। এ কারণেই সততাকে আপন করে নিতে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই ইসলামি জিন্দেগির পূর্ণতা অর্জিত হয়।

 

কোরআন ও হাদিসে এর ফজিলত ও প্রয়োজনীয়তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমের বহু স্থানে সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বনকারী নারী-পুরুষের ফজিলত, আখেরাতে তাদের পুরস্কার, তাদের মর্যাদা, সৃষ্টির মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্য হওয়া এবং বিশেষকরে সৃষ্টিকর্তার কাছে তারা যে প্রিয় এ কথাগুলো আলোচনা করেছেন।

 

কোরআন-হাদিস অধ্যয়নে এ কথা বুঝে আসে যে, সততা বিষয়টি অনেক ব্যাপক। সততা শুধু সত্য কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং সত্য কথা বলার সঙ্গে কাজকর্ম, আকিদা-বিশ্বাস সবগুলোয় সততা অন্তর্ভুক্ত।

 

মহান আল্লাহ বলেন, আর কেউ আল্লাহ এবং রাসুলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ-যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন- তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী। (সুরা নিসা, আয়াত : ৬৯)

 

কিয়ামতের দিন সততার কারণে জান্নাত মিলবে সত্যবাদীদের। ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ বলবেন, এই সেই দিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যতার জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ১১৯)

 

সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভ করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ-স্বচ্ছবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গী হও। (সুরা তওবা, আয়াত : ১১৯)।

 

সত্যবাদীদের প্রশংসা ও গুণাবলি উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল, ওরা বলে উঠল, এটা তো তাই, আল্লাহ ও তার রাসুল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তার রাসুল সত্যই বলেছিলেন। আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল। মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদাতবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোনো পরিবর্তন করে নাই।

 

কারণ আল্লাহ সত্যবাদীদের পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্য এবং তার ইচ্ছা হলে মুনাফিকদের শাস্তি দেন অথবা তাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সুরা আহজাব, আয়াত: ২২-২৪।

এ সুরারই ৩৫ নং আয়াতে সততা এবং স্বচ্ছতাসহ অন্যান্য গুণাবলিতে গুণান্বিত নারী-পুরুষের প্রতিদান ও পুরস্কারের আলোচনা করে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।

 

মুমিন স্বচ্ছ, মুনাফিক অস্বচ্ছ। মুমিন স্বচ্ছ, তাই তারা সত্যবাদী। মুমিনরাই যে সত্যবাদী আল্লাহতায়ালা তা অন্য আয়াতে এভাবে বলেছেন, মুমিন তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছে অতঃপর তাতে কোনো সন্দেহে পতিত হয়নি এবং তাদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারাই তো সত্যবাদী। (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৫)

 

মহাগ্রন্থ কোরআনের ন্যায় রাসুলের হাদিসেও সততার অনেক ফজিলত এবং মর্যাদার কথা ফুটে উঠেছে। রাসুলের হাদিসে সততাকে অন্তরের প্রশান্তি, নাজাত লাভ, জান্নাত অর্জন, খোদার সন্তুষ্টি এবং ধনসম্পদে বরকতের মাধ্যম বলা হয়েছে। মুমিন এ জন্যই সত্যবাদী যে, সে যা বলে তার অন্তরেও তা থাকে এবং কাজে কর্মে হুবহু সেটাই বাস্তবায়ন করে দেখায়। এতে কোনো লুকোচুরি বা অস্বচ্ছতা থাকে না। নবীজি (সা.) বলেন, সত্যবাদী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী সিদ্দিক ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। সত্যবাদী ব্যবসায়ী কারা তা হাদিসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালো-মন্দ প্রকাশ করে দেয়, তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে, তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৩২) মিথ্যা বলা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া গর্হিত অপরাধ। মিথ্যাবাদীর পক্ষে যেকোনো ধরনের পাপ করা সম্ভব। কেননা সে পাপ কাজ করে খুব সহজে তা অস্বীকার করতে পারে। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা হলো, কোনো বিষয়ে নিশ্চিত জানাশোনা না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কোনো কথা বলা অপরাধ।

 

অতএব মিথ্যা বলার আগে তা জেনে নেওয়া দরকার। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই, সে বিষয়ের পেছনে পড়ে থেকো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয়—এসবের ব্যাপারে (কিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬) মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘(অনুমানভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক।’ (সুরা: জারিয়াত, আয়াত: ১০) মিথ্যুক আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত এবং সর্বত্র নিগৃহীত। আজকাল মিথ্যা বলাটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যে ব্যক্তি যত পরিমাণ মিথ্যা বলতে পারে, তাকে তত পরিমাণ চতুর, বুদ্ধিমান মনে করা হয়। মিথ্যা, চালাকি, ফাঁকিবাজি এগুলোর গোনাহের অনুভূতি- মানুষের দিল থেকে ওঠে যাচ্ছে। অথচ এগুলো এমন কাজ যার দ্বারা গোটা সমাজ অশান্তি, রিজিকের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে নিপতিত হয়।

 

নবীজি (সা.) বলেছেন, ধীকৃত সে, যে কোনো মুমিনের ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৯৪০)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর নিকট কিছু লোক এসে বললেন, আমরা রাজা-বাদশাদের দরবারে যাই, তখন তাদের সামনে (প্রশংসামূলক) এমন কিছু বলি, যা বাইরে বলি না। এ কথা শুনে হজরত ইবনে ওমর (রা.) বললেন, আমরা এগুলোকে নেফাক (কপটতা, মুনাফেকি) গণ্য করতাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৭৮)। মুসলমান আমিরদের কল্যাণকামিতার বিষয়ে যে হাদিস এসেছে তার ব্যাখ্যায় ইমাম নববি বলেন, তাদেরকে যেন মিথ্যা প্রশংসা শুনিয়ে ধোঁকা না দেয়। এটাও কল্যাণকামিতার অংশ।

 

হাদিসে আছে, উম্মতের ব্যাপারে আমার যে বিষয়গুলোকে ভয়, তন্মধ্যে ভয়ংকরতম হচ্ছে বাকপটু মুনাফিক। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১/২২)

সাহাবি হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, স্বভাবগতভাবে একজন মুমিনের মাঝে (ভালো-মন্দ) সব চরিত্রই থাকতে পারে, দুটি চরিত্র ছাড়া এক. খিয়ানত, দুই. মিথ্যা। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২২১৭০; শুআবুল ঈমান, বাইহাকি, হাদিস: ৪৪৭১)

 

স্বচ্ছতার প্রশংসা করে নবীজি (সা.) বলেন, আমার সুপারিশ তার জন্য যে সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এমন এখলাসের সঙ্গে যে, তার অন্তর তার মুখকে সত্যায়ন করবে এবং মুখ অন্তরকে সত্যায়ন করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৮০৭০। নাটক, মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিথ্যা বলাটাকে জরুরি মনে করা হয়। অথচ নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে, তবে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস। (সুনানে আবু দাউদ)। এককালে মানুষ বিভিন্ন কিসসা-কাহিনি বলতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিত। কিন্তু এখন তো মানুষ কথায় কথায় দেদারছে মিথ্যা বলে। মনে রাখতে হবে! মিথা কথা বলার কারণে লোকেরা তো হাসবে কিন্তু হাদিসের ভাষ্যমতে আল্লাহর ফেরেশতারা এই মিথ্যার দুর্গন্ধের কারণে অনেক মাইল দূরে চলে যায়। (জামে তিরমিজি) চিন্তা করে দেখতে হবে জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতি পদক্ষেপে আমরা মিথ্যার কি পরিমাণ আশ্রয় নিচ্ছি। সততা থেকে কত পিছিয়ে আমরা।

 

এ কথা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, মিথ্যাকে একটি ফ্যাশনে পরিণত করা এবং নবী-রাসুলদের গুণ-সততা থেকে পিছিয়ে থাকা মূর্খতা এবং বোকামি ছাড়া আর কি হতে পারে?

তার সম্মান সবার কাছে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। মুমিন মুসলিমের জন্য সততা এক অপরিহার্য গুণ। আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যানুসারীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তাওবা: ১১৯)।

সততা, সত্যনিষ্ঠা ও সত্যবাদিতা একটি মহৎ মানবিক গুণ। প্রকৃত মানুষ বা ইনসানে কামেল হওয়া যায় না যেসব গুণ ছাড়া, সততা তন্মধ্যে অন্যতম। এ সততা রক্ষা করতে হয় প্রতিনিয়ত চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, আমানতদারিতায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে এ নৈতিক গুণ অর্জন করতে হয়।

 

জীবনের পরতে পরতে সততার অনুশীলন করতে হয়। একটি মহৎ মানবিক গুণ হিসেবে নিজ নিজ চরিত্রে একে প্রতিস্থাপন করতে হয় এবং তাকে সংরক্ষণ করে চলতে হয়। বিষয়টি জীবনঘনিষ্ঠ, প্রাত্যহিক চর্চার ও অনুশীলনের। সৎ মানুষের মর্যাদা পৃথিবীর তাবৎ মানবগোষ্ঠী দিয়ে থাকে।

 

মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে সততা। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য, জীবনে সততা ও বিশ্বস্ততার ফসল আহরণে যত্নবান হওয়া, কেননা সততা ও সত্যবাদিতা আখলাকে হাসানের অন্যরকম বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে এ গুণের সমাহার থাকবে সমাজের সব ধরনের লোক তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। সর্বোপরি আখেরাতে আল্লাহর কাছে এর বিনিময় লাভ করবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে।

 

তাই আমাদেরকে সদা সর্বদা কথা ও কাজে সততা, সত্যতা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করতে হবে। মিথ্যার অভিশাপ ও গ্লানি থেকেও বাঁচতে হবে। তাহলে মানুষ আমাদেরকে শ্রদ্ধা করবে এবং মহান আল্লাহও দেবেন আখেরাতে এর যথোপযুক্ত বিনিময়। বর্তমান প্রজন্মের সবারই ব্রত হওয়া উচিত ‘সদা সত্য কথা বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না।’

 

মিথ্যাবাদীকে আল্লাহও ঘৃণা করেন:-

 

মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়। একটি মিথ্যা থেকে শতশত পাপের সূত্রপাত হয়। তাই খুব সাধারণ বিষয়েও মিথ্যা কথা বলা ঠিক নয়। এতে করে যে কেউ ধীরে ধীরে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন মিথ্যা কথা বলতে আর দ্বিধাবোধ করে না। যে কোনো বিষয়ে মুখ দিয়ে অকপটে মিথ্যা বের হয়ে আসে।

 

মিথ্যাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই কেবল ঘৃণা করা হয় না বরং সব বর্ণের-ধর্মের মানুষ মিথ্যাকে ঘৃণা করে। যারা কোনো ধর্ম মানে না, তারাও মিথ্যাকে ঘৃণা করে। যারা অনর্গল মিথ্যা বলে, তারাও মিথ্যাকে ঘৃণা করে। মিথ্যাবাদীও চায়, অন্যেরা তার সঙ্গে সত্য কথা বলুক।

 

খুব আফসোস করে বলতে হয়, আমরা দিনে দিনে মিথ্যার রাজ্যে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, আমরা কখন যে মিথ্যা কথা বলছি, সেটা নিজেরাই বুঝতে পারি না। কথায় কথায় খুব সাধারণ বিষয়ে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে ফেলি। অতি সাধারণ বিষয়েও মিথ্যা বলা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

 

আমরা যতই তাদের শিক্ষা দিয়ে থাকি, মিথ্যা বলা মহাপাপ কিন্তু নিজেরাই যদি মিথ্যা বলা থেকে বের না হয়ে আসতে পারি, তাহলে তারাও আমাদের থেকে মিথ্যা কথা বলা শিখে যায়।

 

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মিথ্যা বলাটা সহজ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মোবাইল কল বা মেসেজে। ঘরে অবস্থান করে বলে বাইরে। বাইরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে বলা হয় অফিসে বা কর্মস্থলে। ধর্ম-কর্মে মিথ্যার মাধ্যমে ধোঁকাবাজি প্রতিনিয়ত চলছেই। মিথ্যা এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, এটা কিছু লোকের অবিচ্ছেদ্য স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আমরা মিথ্যার এত কাছাকাছি বাস করছি, এটা পাপ বা সর্বজনস্বীকৃত ঘৃণ্য কাজ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি একটুও বিরক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না। মিথ্যা একাল-ওকাল দুটোই ধ্বংস করে। অথচ মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলে প্রায় সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। বাঁচা যায় পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে। মিথ্যা বলার চেয়ে নিকৃষ্ট গুনা আর নেই। তাই মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। আল কোরআন ও হাদিসে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা মিথ্যাবাদী থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।’ (তিরমিজি : ১৯৭২) হিংসাপরায়ণ হয়ে মিথ্যা বলা, মন্দ ধারণা থেকে মিথ্যা বলা, বিদ্বেষী মনোভাব থেকে মিথ্যা বলা, বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে মিথ্যা বলছি অহরহ। আল্লাহতায়ালা মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করেন এবং এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আল্লাহ আল কোরআনে হুশিয়ার করে বলেন, ‘সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক (দ্বিমুখিতা) রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে। (সূরা তওবা, আয়াত : ৭৭)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, এক সময় আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর কাছে এক সময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়’। (বুখারি : ৫৭৪৩, মুসলিম : ২৬০৭)।

 

আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ বাক্য আছে। ‘চিলে কান নিল’ বলে অযথা চিলের পেছনে দৌড়ানো। অথচ হাত দিয়ে একবারও কানটা ধরে দেখনি আসলেই কান নিয়েছে কিনা। এটাকে বলে ‘কানকথা’ বা ‘শোনা কথা’। কোনো কথা শুনেই এখানে-সেখানে বলে বেড়ানো হাদিসের ভাষায় এটাকেও মিথ্যা বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কারও কাছে কোনো কথা শোনামাত্রই তা বলে বেড়ানো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম : ৯৯৬)।

 

মিথ্যাবাদী হওয়া মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’। ওদের যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে অনাচার কর না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী। জেনে রাখ, ওরাই অনাচার বিস্তারকারী, কিন্তু ওদের চেতনা নেই’। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১০-১২)।

 

যারা মিথ্যাবাদী, তারা এতে সাময়িক সুবিধা পেলেও ইহকালে এরা নিন্দিত হবে এবং পরকালে পাবে কঠিন শাস্তি। যারা সত্যবাদী, তাদের জীবনের পথচলা একটু কঠিন হলেও তারা ইহকালে হবে সম্মানিত এবং পরকালে পাবে উপযুক্ত পুরস্কার।

 

মানবজীবনে মিথ্যার কুপ্রভাব:-

 

মিথ্যাকে বলা হয় সব পাপের জননী। মুনাফিকের অন্যতম অভ্যাস। কোনো মিথ্যা হাজারো মিথ্যার জন্ম দেয়। মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষ হাজারো পাপে লিপ্ত হয়।


মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়-

 

মিথ্যা মানুষের মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়। মানুষকে সার্বক্ষণিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে রাখে। তাই শান্তিময় জীবনের জন্য মিথ্যা ত্যাগ করা জরুরি। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবুল হাওরা আস-সাদি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসান ইবনু আলী (রা.)-কে আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোন কথাটা মনে রেখেছেন? তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই কথাটি মনে রেখেছি—‘যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে দিয়ে যাতে সন্দেহের সম্ভাবনা নেই তা গ্রহণ করো।


যেহেতু, সত্য হলো শান্তি ও স্বস্তি এবং মিথ্যা হলো দ্বিধা-সন্দেহ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৮)

অন্তরকে রোগাক্রান্ত করে-

মিথ্যা অন্তরকে রোগাক্রান্ত করে। যে রোগ মানুষকে হক থেকে বঞ্চিত করে এবং জাহান্নাম পর্যন্ত নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে মুনাফিকদের এই রোগের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি, অথচ তারা মুমিন নয়।


তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজদেরই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। তাদের অন্তরে আছে ব্যাধি, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৮-১০)

জীবন সংকুচিত করে দেয়-

 

বাহ্যিকভাবে মিথ্যুকদের অনেক সফল মনে হলেও মূলত তারা বঞ্চিত ও ব্যর্থ। কারণ হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণ।


মিথ্যাচারিতা জীবিকা সংকুচিত করে দেয় এবং দোয়া দ্বারা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে।

(আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ৪৪৮৮)

ফেরেশতারা দূরে সরে যায়-

যারা মিথ্যা বলে, ফেরেশতারা তাদের এই মিথ্যার দুর্গন্ধে তাদের থেকে দূরে সরে যায়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবন উমার (রা.) সূত্রে নবী (সা.) বলেছেন, বান্দা যখন মিথ্যা কথা বলে, ফেরেশতারা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধের কারণে এক মাইল দূরে চলে যায়। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ৪৪৮৯)

হাদিসটির সনদ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করলেও ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, হাদিসটি হাসান।

হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়-

যারা অধিক মিথ্যা বলে এমন সীমা লঙ্ঘন করে মহান আল্লাহ তাদের হিদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না, যে সীমা লঙ্ঘনকারী, মিথ্যাবাদী।’ (সুরা : মুমিন, আয়াত : ২৮)

আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে-

মিথ্যাবাদী আল্লাহর অপছন্দের পাত্র। এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে খ্রিস্টানদের অতিরঞ্জিত মিথ্যা তথ্য প্রদান ও তর্কের মোকাবেলায় মুবাহালার শিক্ষা দেন। মুবাহালার অর্থ হলো, দুই পক্ষের একে অপরের প্রতি অভিসম্পাত করা। অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিষয়ের সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে তর্কবিতর্ক হলে এবং দলিলাদির ভিত্তিতে মীমাংসা না হলে, তারা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করবে যে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের উভয়ের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী, তার ওপর তোমার অভিশাপ বর্ষণ হোক!’

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “অতঃপর তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে ঝগড়া করে, তবে তুমি তাকে বলো, এসো আমরা ডেকে নিই আমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সন্তানদের। আর আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের, তারপর আমরা বিনীত প্রার্থনা করি, ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লানত করি’।”

(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৬১)

পাপাচারে লিপ্ত করে-

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা মিথ্যাচার বর্জন করো। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যাচারকে স্বভাবে পরিণত করলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যুক হিসেবেই লেখা হয়। আর তোমরা অবশ্যই সততা অবলম্বন করবে। কেননা সততা নেক কাজের দিকে পথ দেখায় এবং নেক কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর কোনো ব্যক্তি সর্বদা সততা বজায় রাখলে এবং সততাকে নিজের স্বভাবে পরিণত করলে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তার নাম পরম সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।

আসুন, সত্য গ্রহণ করি। মিথ্যা বর্জন করি। সত্যের সাথে থাকি, মিথ্যা পরিহার করি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।

 

সংকলনঃ

মোঃ নাজিমুল হাসান খান
torunsongo@gmail.com 

যাকাতের পরিচয়, নিসাব সীমা নির্ধারণ, যাকাত বণ্টনের খাত ও পদ্ধতি ।

আমাদের দেশে স্বর্ণ, রৌপ্য, সম্পদ ও নগদ অর্থের যাকাত দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও অন্যান্য যাকাতযোগ্য মালের অর্থ যথাযথভাবে দান করা হয় না । সামাজিক...