ধন-সম্পদের
মোহ ও মনের পাশবিকতা দূরীকরণের মহান শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর আসে পবিত্র কুরবানি।
ইসলাম ধর্মে কুরবানির দিনকে ঈদুল আজহাও বলা হয়। কুরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু
থেকে এসেছে। অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা, সান্নিধ্য অর্জন করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর
সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। শরিয়তের পরিভাষায়-নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ
পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান
আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করাই হলো কুরবানি।
কুরবানি
হলো ইসলামের একটি মহান নিদর্শন। কুরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন-‘তোমার
প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানি কর।’ (সূরা কাউসার, আয়াত-২)।
হজরত
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে’।
(ইবনে মাজাহ-৩১২৩)।
যারা
কুরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী। কুরবানির রক্ত প্রবাহিত
করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না উহার (জন্তুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের
তাকওয়া। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৭)।
কুরবানিতে
গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে অধিকাংশ সময় গোশত খেতে পারে না, তারাও
গোশত খাবার সুযোগ পায়। কুরবানির চামড়ার টাকা গরিবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে তাদের
অভাব ও দুঃখ মোচন হয়। অপরদিকে কুরবানির চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন
করে থাকে।
কোরবানির
ইতিহাস অতি প্রাচীন। কোরআনে হাবিল-কাবিলের ঘটনাই তার প্রমাণ। ইসলামে প্রথম কোরবানি
এটি। হাবিল প্রথম মানুষ, যিনি আল্লাহর জন্য একটি পশু কোরবানি করেন। ধর্মীয় বিবরণ
থেকে জানা যায়, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার
উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন।
সে
সময় আল্লাহর নির্ধারিত শরিয়ত বা পদ্ধতি ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন নেমে আসবে এবং
যার কোরবানি কবুল হবে তার জিনিস গ্রহণ করবে। অর্থাৎ অগুন সে জিনিসকে জালিয়ে ভষ্ম
করে দেবে। সেই অনুযায়ী, আকাশ থেকে নেমে আসা নেককার হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কোরবানি
গ্রহণ করে। অন্যদিকে কাবিলের ফসলস্বরূপ প্রদত্ত কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হয়।
তবে
পবিত্র ইসলামে আমরা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর স্মরণে
কুরবানি করে থাকি। এ প্রসঙ্গে ইবনে মাজাহ শরিফে এসেছে, হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম
(রা.) থেকে বর্ণিত, ‘কতিপয় সাহাবি প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কুরবানি
কী? হজরত রাসূলে মকবুল (সা.) বললেন, তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত।’
সাহাবারা বললেন, এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন,
প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ-৩১২৭)।
কুরবানির
গুরুত্বারোপ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ইবরাহিম! স্বপ্নে দেওয়া আদেশ তুমি সত্যে
পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল
একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম। (সূরা
সাফফাত, আয়াত নং ১০৪-১০৭)।
আবু
হানিফা ও ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মতে কুরবানি ওয়াজিব। তাদের দলিল হলো-আল্লাহতায়ালা
নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু জবেহ কর।’
(সূরা কাওসার, আয়াত-২)। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন সাধারণত ফরজ
বা ওয়াজিব হয়ে থাকে। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা
সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে’। অত্র হাদিসের
ভাষ্যেও কুরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। তবে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতে
কুরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
কুরবানির
নেসাব হলো হাজাতে আসলিয়া তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও
উপার্জনের উপকরণ ইত্যাদি ব্যতিরেকে যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা
রৌপ্য কিংবা তার মূল্য বা সমমূল্যের সম্পদের মালিক হওয়া। প্রকাশ থাকে যে, জাকাতের
নেসাব যা, কুরবানির নেসাবও তা। তবে কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে একটু অতিরিক্ত বিষয়
রয়েছে। তা হলো- অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য অতিরিক্ত আসবাবপত্র, সৌখিন
মালপত্র, খোরাকি বাদে অতিরিক্ত জায়গা-জমি, খালিঘর বা ভাড়া ঘর (যার ভাড়ার ওপর
জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য কুরবানির নেসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
(ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া-৫/২৯২)।
জাকাত
ও কুরবানির নেসাবের সময়সীমা নিয়েও পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো-জাকাতের নেসাব পূর্ণ এক
বছর ঘুরে আসা শর্ত; কিন্তু কুরবানির নেসাব পূর্ণ এক বছর ঘুরে আসা শর্ত নয়। কেবল
জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এই তিন দিনের যে কোনো একদিন নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক
হলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে শামি)।
এমন
পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে; আর তা হলো ছয় ধরনের
পশু। সেগুলো হলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানির
পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দুই বছরের
হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা পূর্ণ এক বছরের হতে হবে। তবে যদি ছয় মাস বয়সের ভেড়া
বা দুম্বা মোটাতাজায় এক বছরের মতো মনে হয়, তখন তা দিয়েও কুরবানি করা জায়েজ আছে।
কিন্তু ছাগল যতই মোটাতাজা হোক, এক বছরের একদিন কম হলেও তা দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে
না। যেমন হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ
করেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কুরবানি করবে। তবে তা
তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানি করতে পার’। (সহিহ
মুসলিম-১৯৬৩)।
গরু, মহিষ ও উট এই জাতীয় যে পশুগুলো
কোরবানির জন্য বৈধ, সেগুলোর মধ্যে ভাগে কোরবানি দেওয়া জায়েজ। নবী করীম
(সা.) সাত ভাগ পর্যন্ত কোরবানি দেওয়া অনুমোদন করেছেন। সহিহ মুসলিমের একটি
হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রাসুল (সা.) উটের মধ্যে ১০ ভাগ পর্যন্ত কোরবানি
দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন। তবে শরিক হয়ে কোরবানি করলে কিছু বিষয় জানা জরুরি।
যেমন, উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং
সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা
জায়েজ। (মুসলিম: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭) এভাবে একটি বড় পশুতে
সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হয়ে কোরবানি দিতে পারবে।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা হুদায়বিয়ার সনে উট
সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরুও সাত জনের পক্ষ থেকে কোরবানি করেছিলাম।’ (সহিহ মুসলিম: ২৩২২, আবু দাউদ: ২৮০৯, তিরমিজি: ১৪২২, ইবনে মাজাহ: ৩১৩২)
আপনি চাইলে একটি গরু বা মহিষ দুই, চার বা ছয় ভাগেও কোরবানি করতে
পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে- কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান
হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ,
কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস
সানায়ে: ৪/২০৭)
কেউ যদি গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে ক্রয় করে, এ পশুতে
অন্যকে অংশীদার করাও তার জন্য জায়েজ। তবে ধনী হলে এতে কাউকে শরিক না করে
একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম।
আবার কোরবানি ওয়াজিব হয়নি—এমন কেউ যদি কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করে
থাকে, তাহলে যেহেতু কোরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করে আল্লাহর জন্য নির্ধারণ
করেছে, তাই তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে, তবে
ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে
পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। (ফতোয়া কাজিখান: ৩/৩৫০-৩৫১; বাদায়িউস
সানায়ে: ৪/২১০)
তবে সবার আগে যে কথা মনে রাখতে হবে তা হল, কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ
হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা শুদ্ধ নয় এবং এক্ষেত্রে
অন্য অংশীদারদের কোরবানিও শুদ্ধ হবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ
করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি হালাল ও পবিত্র ব্যতীত
কোনোকিছু গ্রহণ করেন না।’ (সহিহ মুসলিম: ২২১৫)
কুরবানির
জন্য পশু আগেই নির্ধারণ করতে হবে। নির্ধারিত পশু জবেহর আগে কোনো কাজে ব্যবহার বা
তা থেকে কোনো ধরনের উপকার নেওয়া যাবে না। যেমন-দান করা, বিক্রি করা, কৃষিকাজে
ব্যবহার করা, দুধ ও পশম বিক্রি করা ইত্যাদি। কুরবানির পশু ছাগল, ভেড়া কিংবা দুম্বা
হলে একটিতে এক ভাগ এবং উট, গরু কিংবা মহিষ হলে একটিতে সাত ভাগে কুরবানি দেওয়া
যাবে। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন,
নিখুঁত ও দেখতে সুন্দর হওয়া। কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হবে।
কুরবানির
উদ্দেশ্যে পশু ক্রয়ের পর যদি বাচ্চা হয় বা জবেহ করার পর তার পেট থেকে বাচ্চা পাওয়া
যায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে হুকুম হলো- মায়ের সঙ্গে বাচ্চাটিকেও কুরবানি করে দিতে হবে।
তবে ওই বাচ্চার গোশত নিজে খাবে না, বরং দান করবে। আর যদি বাচ্চাটি কুরবানি না করে
কোনো গরিব-মিসকিনকে দান করে, তাও জায়েজ রয়েছে। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি-৩/৩৫৪)।
কুরবানি
নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। কুরবানির পশু জবেহ করার সময় হলো ৩
দিন-জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ। এটাই ওলামায়ে কেরামের কাছে সর্বোত্তম মত
হিসাবে প্রাধান্য পেয়েছে। এ সময়ের আগে যেমন কুরবানি আদায় হবে না, তেমনি পরে করলেও
আদায় হবে না। অবশ্য কাজা হিসাবে আদায় করলে ভিন্ন কথা। যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন
তাদের জন্য কুরবানির সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত
আদায়ের আগে কুরবানির পশু জবেহ করা হয়, তাহলে কুরবানি আদায় হবে না। কিন্তু যে
স্থানে ঈদের নামাজ বা জুমার নামাজ বৈধ নয় বা ব্যবস্থা নেই, সে স্থানে ১০ জিলহজ ফজর
নামাজের পরও কুরবানি করা বৈধ হবে। (কুদুরি) আর কুরবানির শেষ সময় হলো জিলহজ মাসের
১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত।
যদি
পশুটি হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় বা মারা যায়, আর কুরবানিদাতা যদি বিত্তশালী হয়
কিংবা তার ওপর পূর্ব থেকেই কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে; তাহলে আরেকটি পশু কুরবানি করা
তার ওপর ওয়াজিব হবে। আর যদি সে গরিব হয় (কুরবানি ওয়াজিব না থাকে), তাহলে তার জন্য
আরেকটি পশু কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। কুরবানির জন্য নতুন পশু ক্রয়ের পরে যদি হারানো
পশুটি পাওয়া যায়, তাহলে কুরবানিদাতা গরিব হলে দুটি পশুই কুরবানি করা ওয়াজিব হবে।
আর ধনী হলে যে কোনো একটি কুরবানি করলেই তার ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। (বাদায়ে
সানায়ে-৪/২১৬)।
ইসলামি
বিধান মতে মোট ছয় ধরনের পশু দিয়ে কুরবানি করা যায়। আর তা হলো-উট, গরু, মহিষ, ছাগল,
ভেড়া ও দুম্বা। এ পশুগুলোকে সুনির্দিষ্ট কিছু দোষ বা খুঁত থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
(কাযিখান ৩/৩৪৮)। সাধারণত পশুর যেসব শারীরিক দোষ, খুঁত বা গঠনের কারণে কুরবানি
আদায় হয় না, তা হলো-১) খোঁড়া পশু : যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে
না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানি জায়েজ নয়। ২) রুগ্ণ ও দুর্বল পশু : এমন
শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানি
করা জায়েজ নয়। ৩) দাঁত নেই এমন পশু : যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে
গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না-এমন পশু দ্বারাও কুরবানি করা জায়েজ নয়। ৪)
যে পশুর শিং ভেঙে বা ফেটে গেছে : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যে
কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে পশুর কুরবানি জায়েজ নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর
অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু কুরবানি
করা জায়েজ। ৫) কান বা লেজ কাটা পশু : যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি
কাটা, সে পশু কুরবানি জায়েজ নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে, তাহলে তার কুরবানি
জায়েজ। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয়, তাহলে অসুবিধা নেই। ৬) অন্ধ পশু : যে পশুর
দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট, সে পশু কুরবানি করা জায়েজ নয়।
কুরবানির
পশু জবেহ করার জন্য রয়েছে কিছু দিকনির্দেশনা। তবে পশু জবেহ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য
অন্তত নিম্নোক্ত দুটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। নতুবা কুরবানির পশু
জবেহ বিশুদ্ধ হবে না। বিষয় দুটি হলো- ১) জবেহ করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে জবেহ করা।
তবে ‘বিসমিল্লাহ’-এর সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবার’ যুক্ত করে নেওয়া মুস্তাহাব।
ইচ্ছাকৃতভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা পরিত্যাগ করলে জবেহকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর
যদি ভুলবশত বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয়, তবে তা খাওয়া বৈধ। কোনো ব্যক্তি যদি জবেহ করার
সময় জবেহকারীর ছুরি চালানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে, তবে তাকেও ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু
আকবার’ বলতে হবে; নতুবা জবেহ শুদ্ধ হবে না। ২) জবেহ করার সময় কণ্ঠনালি, খাদ্যনালি
এবং উভয় পাশের দুটি রগ অর্থাৎ মোট চারটি রগ কাটা জরুরি। কমপক্ষে তিনটি রগ যদি কাটা
হয়, তবে কুরবানি বিশুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দুটি রগ কাটা হয়, তখন কুরবানি বিশুদ্ধ
হবে না। (হিদায়া)।
কুরবানির
গোশত কুরবানিদাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা খেতে পারবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
‘অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও’। (সূরা হজ্জ,
আয়াত-২৮)। ফোকাহায়ে
কেরাম বলেছেন, কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ দরিদ্রদের
দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসাবে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা
মুস্তাহাব। কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা অন্য কোনো কিছু বিক্রি করা জায়েজ
নেই। কারণ তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত বস্তু। তবে চামড়া বিক্রি করা যেতে পারে,
কিন্তু টাকা গরিবদের দান করতে হবে। কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসাবে কুরবানির
গোশত দেওয়া জায়েজ নয়। যেহেতু সেটিও এক ধরনের বিনিময় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মতো। তার
পারিশ্রমিক আলাদাভাবে প্রদান করতে হবে। হাদিসে এসেছে-‘আর তা প্রস্তুতকরণে তা থেকে
কিছু দেওয়া হবে না’। (সহিহ বুখারি-১৭১৬)। তবে দান বা উপহার হিসাবে কসাইকে কিছু
দিলে তা নাজায়েজ হবে না।
আল্লাহতায়ালা
মুসলিম উম্মাহকে কুরবানি আদায়ের ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ খেয়াল
রেখে সঠিক নিয়মে কুরবানির পশু জবেহ করে একনিষ্ঠতার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য কুরবানি
আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
সংকলনঃ
মোঃ নাজিমুল হাসান খান
torunsongo@gmail.com