এর ধারাবাহিকতায় “আত্মহত্যা” বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরী ও সমকালীন কিছু ঘটনার জন্য সময় উপযুক্ত বলে ধারণা করছি।
“বিশ্বে আত্মহত্যা প্রবণতায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম- ডব্লিউএইচও”
কি ভয়ানক তথ্য!!!
Suicide হচ্ছে আত্মহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ। লাতিন ভাষা Sui Sediur থেকে মূলত Suicide শব্দের উৎপত্তি। আত্মহত্যা বর্তমান সমাজে সংঘটিত জঘন্যতম পাপকাজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এ কারণেই ইসলামে আত্মহত্যা করা কবিরা গোনাহ। নিজেই নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার নাম আত্মহত্যা।
সাধারণভাবে, পৌত্তলিক জগতের রোমান ও গ্রীক উভয়েরই আত্মহত্যার প্রতি শিথিল মনোভাব ছিল।
আরলেস কাউন্সিলের (৪৫২) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "যদি কোন দাস আত্মহত্যা করে তবে তার মনিবের উপর কোন নিন্দা আসবে না।" প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদদের মধ্যে খ্রিস্টীয় শত্রুতার কিছু পূর্বসূরি রয়েছে যারা আত্মহত্যা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পিথাগুরাস এই কাজের বিরুদ্ধে ছিলেন, যদিও নৈতিক ভিত্তির চেয়ে বেশি গাণিতিক ছিল, তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীতে ব্যবহারের জন্য কেবল সীমাবদ্ধ সংখ্যক প্রাণ রয়েছে এবং একের আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রস্থান এর ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করবে।
আত্মহত্যার প্রবণতার কারনঃ
বর্তমান সময়ে সমাজে নানা শ্রেণির নানা পেশার মানুষের মাঝে আত্মহত্যার ব্যাপক প্রবণতা লক্ষণীয়। সম্প্রতি গবেষকরা আত্মহত্যার পেছনে কিছু মুখ্য কারণ উদ্ঘাটন করেছেন। আত্মহত্যার এ প্রবণতা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় উঠতি বয়সী তরুণ ও তরুণীদের মাঝে।
অনেকেই যেসব কারণে এ অপরাধে জড়িত হয়-
১. পারিবারিক কলহ
২. জীবন সংগ্রামে বিভিন্ন কাজে ব্যর্থতা ও হতাশা
৩. স্বামী ও স্ত্রীর বা পিতামাতার মাঝে মনোমালিন্য
৪. মানসিক অবসাদ ও যন্ত্রণা উল্লেখযোগ্য
৫ উচ্চাভিলাষী
৬ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কিংবা ভালো ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতা হওয়া
আত্মহত্যার লোমহর্ষক পথঃ
কখনো অস্ত্র দিয়ে নিজেকে আঘাত করে, কখনো ফ্যানে বা ছাদে বা অন্য কোনো কিছুর ওপর লটকে ফাঁস দিয়ে, বিষপান করে, গাড়ি বা রেলের চাকায় ফেলে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ছাদের ওপর থেকে লাফ দিয়ে, আত্মঘাতী বোমা শরীরে বেঁধে হামলা করার মাধ্যমে, গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে ও ছুরিকাঘাতে আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা একটি মহাপাপ। যেভাবেই সে আত্মহত্যা করুক না কেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا تَقْتُلُوْا أَنْفُسَكُمْ، إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيْمًا»
‘‘এবং তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু’’। (নিসা’ : ২৯)
জুন্দাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
كَانَ بِرَجُلٍ جِرَاحٌ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَقَالَ اللهُ: بَدَرَنِيْ عَبْدِيْ بِنَفْسِهِ، حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْـجَنَّةَ.
‘‘জনৈক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে সে তার ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন: আমার বান্দাহ্ স্বীয় জান কবযের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করেছে অতএব আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম’’। (বুখারী ১৩৬৪)
সাবিত্ বিন্ যাহ্হাক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ فِيْ الدُّنْيَا عَذَّبَهُ اللهُ بِهِ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ.
‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন বস্ত্ত দিয়ে আত্মহত্যা করলো আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে সে বস্ত্ত দিয়েই শাস্তি দিবেন’’।
(বুখারী ১৩৬৩, ৬০৪৭, ৬১০৫, ৬৬৫২; মুসলিম ১১০)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ فَحَدِيْدَتُهُ فِيْ يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِيْ بَطْنِهِ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ شَرِبَ سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.
‘‘যে ব্যক্তি কোন লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্ত দিয়ে আত্মহত্যা করলো সে লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্তটি তার হাতেই থাকবে। তা দিয়ে সে জাহান্নামের আগুনে নিজ পেটে আঘাত করবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে বিষ পান করতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে লাফাতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে’’। (বুখারী ৫৭৭৮; মুসলিম ১০৯)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
الَّذِيْ يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِيْ النَّارِ، وَالَّذِيْ يَطْعَنُهَا يَطْعَنُهَا فِيْ النَّارِ.
‘‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে এবং যে ব্যক্তি নিজকে বর্শা অথবা অন্য কোন কিছু দিয়ে আঘাত করে আত্মহত্যা করলো সেও জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে’’। (বুখারী ১৩৬৫)
আত্মহত্যা জাহান্নামে যাওয়ার একটি বিশেষ কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আগাম সংবাদ দিয়েছেন।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ’হুনাইন্ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। পথিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুসলিম সম্পর্কে বললেন: এ ব্যক্তি জাহান্নামী। যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো তখন লোকটি এক ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং সে তাতে প্রচুর ক্ষত-বিক্ষত হলো। জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! যার সম্পর্কে আপনি ইতিপূর্বে বললেন: সে জাহান্নামী সে তো আজ এক ভয়ানক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করলো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারো বললেন: সে জাহান্নামী। তখন মুসলিমদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে সন্দিহান হলো। এমতাবস্থায় সংবাদ এলো: সে মরেনি; সে এখনো জীবিত। তবে তার দেহে অনেকগুলো মারাত্মক ক্ষত রয়েছে। যখন রাত হলো তখন লোকটি আর ধৈর্য ধরতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সংবাদ দেয়া হলে তিনি বলেন: আল্লাহ্ সুমহান। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দাহ্ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। অতঃপর তিনি বিলাল (রাঃ) কে এ মর্মে ঘোষণা দিতে বললেন যে,
إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ إِلاَّ نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ، وَإِنَّ اللهَ يُؤَيِّدُ هَذَا الدِّيْنَ بِالرَّجُلِ الْفَاجِرِ.
‘‘একমাত্র মু’মিন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো কখনো কোন কোন গুনাহ্গার ব্যক্তির মাধ্যমেও ইসলামকে শক্তিশালী করে থাকেন’’। (মুসলিম ১১১)
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَهْوَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ ، يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ تَحَسَّى سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَسَمُّهُ فِى يَدِهِ ، يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ ، فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ ، يَجَأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ».
‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে। [সহীহ বুখারী : ৫৪৪২; মুসলিম : ১০৯]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ خَنَقَ نَفْسَهُ فِي الدُّنْيَا فَقَتَلَهَا خَنَقَ نَفْسَهُ فِي النَّارِ ، وَمَنْ طَعَنَ نَفْسَهُ طَعَنَهَا فِي النَّارِ ، وَمَنِ اقْتَحَمَ ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ اقْتَحَمَ فِي النَّارِ».
‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।’ [সহীহ ইবন হিব্বান : ৫৯৮৭; তাবরানী : ৬২১]
কিছু ভয়ানক তথ্যঃ
বিগত বছরগুলোতে আত্মহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরিসংখ্যান অন্তত আমাদের তা-ই মনে করিয়ে দেয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের অবস্থা একই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে বলে জানা গেছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দশম।
বাংলাদেশ পুলিশ হেড কোয়ার্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৫টি। আর ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬০০, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ এবং ২০১৪ সালে তা ছিল ১০ হাজার ২০০টি। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, প্রতি বছরই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে এবং গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন করে আত্মহত্যা করছে। বড়দের সাথে শিশু ও কিশোররাও আত্মহত্যা করছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের মতে, শুধু ২০১৭ সালেই ৭৬ জন আত্মহত্যা করে, যা গত ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিল ৫৩৪। আরো শঙ্কার বিষয় হলো- সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের এক রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমন অবস্থা কারোরই কাম্য নয়। এটি মনে রাখা জরুরি যে, একটি আত্মহত্যা শুধু একটি জীবনকে শেষ করে দেয় না বরং একটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি গোটা মানবজাতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। কিন্তু কিভাবে? সে নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার কোনো অন্ত নেই।
বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মানুষ
আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস-২০২১ উপলক্ষে
এক আলোচনা সভায় ডব্লিউএইচওর এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। এ বছর
দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল (ক্রিয়েটিং হোপ থ্রো অ্যাকশন) বা ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা। বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
অবস্থান বিশ্বে দশম।
গত একযুগে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০১৯-২০ করোনার সময়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। যাদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বয়সীরাই বেশি। বর্তমানে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আত্মহত্যার পরিমাণ তিন গুণ।
আত্মহত্যার চেষ্টা কি অপরাধ?
পৃথিবীতে একমাত্র অপরাধ, যে অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে পৃথিবীতে কোন অপরাধ হয় না- বরং অপরাধটির চেষ্টা করলেই কেবল অপরাধ হয়। অর্থাৎ আত্মহত্যা করলে অপরাধ হয় না, আত্মহত্যার চেষ্টা করলে অপরাধ হয়। আত্মহত্যা করে ফেললে মৃত ব্যক্তিরতো আর সাজা হতে পারেনা- তাই না?
(পেনাল কোড-১৮৬০) দন্ডবিধির ৩০৯ ধারায় বলা আছে যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবার উদ্যোগ করে এবং অনুরূপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে , সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে যাহার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে ।
আত্মহত্যা করবার চেষ্টার অপরাধে শাস্তি এই ধারায় বলা হয়েছে । যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেন এবং সেই উদ্দেশ্যে কোন কাজ করেন , সে ব্যক্তি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
আইনের জগতে একটি সরল ধাঁধার প্রচলন দেখা যায় । বলুনতো এমন কোন অপরাধ আছে যাহা করলে শাস্তি হয় না, কিন্তু করবার উদ্যোগ করলে শাস্তি হয়? উক্ত ধাঁধার উত্তর এই ধারার মধ্যে নিহিত । এই ধারার যে কাজের কথা বলা হয়েছে তা একবার করে ফেললে যিনি উহা করেন তিনি সকল আইন এবং শাস্তির উর্ধ্বে চলে যান । যিনি আত্মহত্যা করেন , তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না । সুতরাং আত্মহত্যা এমন একটি অপরাধ যাহা করলে শাস্তি হয় না । কিন্তু আত্মহত্যার উদ্যোগ করলে এই ধারায় শাস্তি পেতে হয় ।
উদ্দ্যোগ বলতে শুধু আস্ফালন বুঝায় না । আত্মহত্যা করব বলে প্রকাশ বা প্রচার করলেই তা উদ্যোগরূপে গণ্য হয় না । এমনকি পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করবার কথা বলে পানির দিকে ছুটে যাওয়াও উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা নহে ; মত পরিবর্তনের সুযােগ তার তখনও ছিল । সুতরাং সেটা প্রস্তুতি।
আত্মহত্যায় প্ররোচনার জন্য বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী শাস্তির বিধান আছে। এখানে বলা আছে-আত্মহত্যায় প্ররোচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে কারো প্ররোচনার জন্য আত্মহত্যার চেষ্টা করেও যদি কেউ মারা না যায় তাহলে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দানকারীকে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হতে পারে। তবে অবশ্যই তা প্রমাণ সাপেক্ষে।
বাংলাদেশের প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী আত্মহত্যাকারীর রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট প্ররোচনা দানকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধুমাত্র একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সুইসাইড নোটের সমর্থনে আরো সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হবে।
আত্মহত্যা রোধে করণীয়-
মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো দিন কাটে সুখে, কখনো কাটে দুঃখে। কখনো আসে সচ্ছলতা। আবার কখনো দেখা দেয় দরিদ্রতা। কখনো থাকে প্রাচুর্য কখনো আবার অভাব-অনটন। কখনো ভোগ করে সুস্থতা কখনো আক্রান্ত হয়ে পড়ে রোগ শোকে। কখনো দেখা দেয় সুদিন, আবার কখনো আসে দুর্ভিক্ষ। কখনো আসে বিজয়, আবার কখনো আসে পরাজয়। কখনো আসে সম্মান আবার কখনো দেখা দেয় লাঞ্ছনা। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমাদের সময়েই হয়ে থাকে, তা নয়। এটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই আবর্তিত হয়ে আসছে।
আল্লাহ যেমন বলেন,
﴿ ثُمَّ بَدَّلۡنَا مَكَانَ ٱلسَّيِّئَةِ ٱلۡحَسَنَةَ حَتَّىٰ عَفَواْ وَّقَالُواْ قَدۡ مَسَّ ءَابَآءَنَا ٱلضَّرَّآءُ وَٱلسَّرَّآءُ فَأَخَذۡنَٰهُم بَغۡتَةٗ وَهُمۡ لَا يَشۡعُرُونَ ٩٥ ﴾ [الاعراف: ٩٤]
‘তারপর আমি মন্দ অবস্থাকে ভাল অবস্থা দ্বারা বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা প্রাচুর্য লাভ করেছে এবং বলেছে, ‘আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও দুর্দশা ও আনন্দ স্পর্শ করেছে’। {সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৯৫}
যেহেতু বিপদ-আপদ, কষ্ট-শোক আমাদের নিত্যসঙ্গী তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে প্রথমত দরকার পুরো সমাজ ব্যবস্থায় ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন। কারণ, মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় হতাশার চরম মুহূর্তে। আর অনুশীলনরত মুসলিম জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই।
আল্লাহ বলেন,
﴿ قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٢]
বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। {সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৫২}
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যাবতীয় ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এবং আল্লাহ যা-ই করেন বান্দার তাতে কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে, সে কখনো নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নিভাবার মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সে তো হাজার বিপদেও অবিচল থাকবে এ বিশ্বাসে যে আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অবশ্যই তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথম দরকার ইসলামী শিক্ষা এবং দৈনন্দিন জীবন ইসলামের বাস্তবানুশীলন।
তদুপরি আল্লাহর কাছে পরস্পরের জন্য দু‘আ করতে হবে। আল্লাহ স্বয়ং আমাদের সে
দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন, এই দু‘আটি আমরা নিয়মিত পড়ব।
ইরশাদ হয়েছে,
﴿ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ [الفرقان: ٧٤]
‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে।
আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’। {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৭৪}
পিতা-মাতার
প্রথম কাজ হবে সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা যা-ই বানান কেন সর্বপ্রথম তাকে কুরআন ও প্রয়োজনীয় ইসলামী জ্ঞান শিখিয়ে
তবেই অন্য কোনো কিছু শেখানো। দ্বিতীয়ত তাদেরকে ইসলামী কায়দায় লালন-পালন সম্পর্কে
জ্ঞান লাভ করতে হবে। তাহলে বুঝতে পারবেন,
কখন সন্তানকে
শাসন করা যাবে আর কীভাবে সন্তানকে শাসন করতে হবে না। না জেনে প্রকৃত তথ্য না বের
করে সাবালক সন্তানদের অযথা বকাঝকাও পরিহার করতে হবে। এমন মানসিক কষ্ট না তাদের
কখনো দেয়া যাবে না যা তাদেরকে আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ দিতে বাধ্য করে।
সর্বোপরি সন্তানের জন্যও পিতা-মাতা উপরোল্লেখিত আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া দু‘আটি পড়বেন।
শিক্ষার্থীদের
মাঝে পারিবারিকভাবে এবং তাদের পাঠ্য বইয়ের মাঝে আল্লাহর ওপর ভরসা, হতাশা জয় করা এবং কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা শুরু থেকেই ঢুকে দিতে
হবে। আর ছাত্র-ছাত্রীদের কর্তব্য হলো,
সারা বছর ঠিক মত
পড়ালেখা করা, শিক্ষাগুরু ও বাবা-মায়ের কথামত প্রতিদিন
রুটিন মেনে পাঠ্য মুখস্থ করা। পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে অতিরিক্ত চেষ্টার পাশাপাশি
আল্লাহর কাছে সালাত পড়ে বিশেষভাবে দু‘আ করা যেতে পারে। হে আল্লাহ। আপনিই তো
জ্ঞান-প্রতিভা-মেধা ও ফল দেয়ার মালিক। এগুলো দিয়ে আমাকে অনুগ্রহ করুন যাতে আমি
পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারি। সর্বোপরি পড়তে বসার সময়, পরীক্ষার হলে বিষয় মনে না এলে,
সালাতের পর এবং
সমসময় আল্লাহর শেখানো বাক্যটি পড়তে পারেন।
আত্মহত্যার কথা
মনে আসলে এ বিপদ থেকে রক্ষাকল্পে নফল নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং সিজদায় গিয়ে
বিনীতভাবে আল্লাহর আগ্রহ-দয়া-সাহায্য কামনা করা প্রয়োজন। প্রতি মুহূর্তে ধৈর্য
ধারণ করতে হবে। মোট কথা যখনই নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হয় এবং আত্মহত্যার চিন্তা
আসে তখনই মনে করতে হবে এখন শয়তান এসেছে। ইসলামে আত্মহত্যা নাজায়েয এবং এর পরিণতি
জাহান্নাম। তাই এ থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। সাথে সাথে মনে করতে হবে আল্লাহই আমার
সহায় এবং আশার আলো। তাই পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায পড়ার সাথে নফল নামাযের মাধ্যমে
আল্লাহর দয়া ও সাহায্য কামনা করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে সবর অর্থাৎ ধৈর্য ধারণ
করতে হবে। এতে ইনশাআল্লাহ মন ও হৃদয় প্রশান্ত থাকবে এবং বিপদ দুরীভূত হবে।
এছাড়াও বহু
ছাত্র-ছাত্রীর জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে-কৃত্রিম ভালোবাসার, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে, অপ্রত্যাশিত আশা-আকাঙ্ক্ষার ফলে। আর
এসবের পেছনে সবচে বড় হাত রয়েছে বেপর্দা ও অশ্লীলতার। একটি সুখী, শান্তিময়, সুন্দর সমাজ গঠনে শালীনতাপূর্ণ, রুচিসম্মত, মার্জিত বেশ ভূষা, চাল চলন ও আচার-আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। অশালীন বেশ ভূষা ও আচার-আচরণ মানুষের
মধ্যকার পশু বৃত্তিকে জাগিয়ে তুলে। কুৎসিত কামনাকে উত্তেজিত করে। এতে নানা রকম
পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নানা ধরনের পাপকর্ম সংঘটিত হয়।
মহাবিপর্যয়, অন্যায় ও অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য মহান
আল্লাহ বিধানকে মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা।
নিজেদের বন্ধু নির্ধারণ ও বৈবাহিক সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে ধর্মীও মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবারকে বিবেচনা করতে হবে। মহাবিপর্যয় এর সময় এই মানুষরাই আপনাকে মানষিক যন্ত্রণার কঠিন মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণে সহযোগিতা করবে।
বিশ্বব্যাপী আত্মঘাতী আচরণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং জীবনের মূল স্রোতের ধারার সাথে মানুষকে যুক্ত করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড (আইএএসপি) এর উদ্যোগে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুক। আত্মহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র: অনলাইন মিডিয়া, নিউজ পেপার, উইকিপিডিয়া
গবেষণা, অনুসন্ধান ও সংকলনঃ